গ্রাফিক্স: শুভম সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: 17th February 2025 17:51
আজ থেকে ১১৮ বছর আগের কথা। সালটা ১৯০৭। মে মাস। রোদেলা দুপুর। দক্ষিণ কলকাতার চক্রবেড়িয়া রোড। ফুটপাথ ধরে সেদিন হেঁটে চলেছিলেন বছর ছাব্বিশের এক যুবক। নফর… পুরো নাম নফরচন্দ্র কুণ্ডু। চলেছিলেন কোনও কাজে। মাথায় হাজারো চিন্তা। স্বদেশব্রতী ছেলে। রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় দীক্ষিত। পরোপকারী, উদারহৃদয়।
হঠাৎ রাস্তা দিয়ে চলার সময় কানে আসে তীব্র আর্তনাদ। সেই সঙ্গে পথচারীদের হইচই। কী হয়েছে দেখার জন্য আওয়াজ লক্ষ করে এগিয়ে যান নফর। দেখেন একটি ম্যানহোল। আর তাকে ঘিরে উত্তেজিত জনতার জটলা। ‘কী হয়েছে? হয়েছেটা কী?’—প্রশ্ন করতেই ভেসে আসে জবাব—ম্যানহোল সাফাইয়ে নেমেছিল দুজন। দুজনেই মুসলিম। তারা কেউই আর বেরোতে পারছে না। ফেঁসে গেছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। এক্ষুনি উদ্ধার করতে না পারলে দম আটকে মারা যাবে তারা। বের করতেই হবে, যেভাবে হোক। কিন্তু কীভাবে? কারা নামবে নীচে? পুলিশকে খবর দেবে কেউ? কিন্তু পুলিশ আসতে আসতে যে সব শেষ হয়ে যাবে!
জটলার গুঞ্জন, আর্তনাদ কানে এলেও মাথা কাজ করছিল না নফরের। কে নেমেছে, কেন নেমেছে, কীভাবে বাঁচানো যাবে তাদের—এতশত প্রশ্নের কোনও জবাব খুঁজতে চাননি তিনি। নফরের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল স্রেফ একটাই চিন্তা—এক্ষুনি যদি নীচে না নামা হয়, তুলে আনা না যায় দুই সাফাইকর্মীকে, তাহলে প্রাণে মারা যাবে তারা। চোখের সামনে দুই যুবক, হয়তো তারই বয়সি, ভরদুপুরে কলকাতার রাজপথে সকলের চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
রামকৃষ্ণের বাণীকে শুধু স্মরণে-মননে নয়, নিজের জীবনেও ধারণ করেছিলেন নফর। তাই কালবিলম্ব না করে জামার আস্তিন গুটিয়ে নীচে নামতে তৈরি হন তিনি।
চোখের সামনে এলাকার ছেলের এমন কাণ্ড দেখে রে রে করে ওঠেন সকলে। কিছুতেই নফরকে ম্যানহোলে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। প্রশিক্ষিত নয় নফর। কোনও আন্দাজ নেই, মাটির নীচে অন্ধকার পূতিগন্ধময় পাঁক কতটা দমবন্ধকর অবস্থা তৈরি করতে পারে। কিন্তু বছর ছাব্বিশের তরতাজা যুবক নফরচন্দ্র কুণ্ডু নাছোড়বান্দা।
সকলের হাত ছাড়িয়ে, নিষেধ অমান্য করে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেদিন ম্যানহোলে নেমে পড়েছিলেন তিনি। তারপরের ঘটনা প্রত্যাশিত… এবং একইসঙ্গে মর্মন্তুদ, হৃদয়বিদারক। ম্যানহোলে ফেঁসে থাকা দুজন যুবককে নফর টেনে তুলেছিলেন। কিন্তু নিজে বেঁচে বেরোতে পারেনি। কোনও প্রশিক্ষণ, কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস, জেদ আর মানুষের প্রতি ভালবাসার জোরে অসাধ্য সাধন করেছিলেন নফর। অন্যের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন নিজের জীবনের বিনিময়ে।
২৬ বছরের আয়ুষ্কালে কোনও স্মরণীয়, অন্তত ইতিহাসের পাতায় ঠাই পাওয়ার মতো কাজ করে যাননি নফরচন্দ্র কুণ্ডু। কোনওদিন জেল খাটেননি, বিপ্লবে যোগ দেননি, গুপ্ত সমিতিতে নাম লিখিয়ে ব্রিটিশ রাজকর্মচারীকে হত্যার ষড়যন্ত্রও করেননি। একজন স্বদেশব্রতী, পরহিতাকাঙ্ক্ষী যুবক হয়েই আজীবন বেঁচেছিলেন তিনি। তবে আপদে-বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।
আর স্রেফ এই কথাটুকু স্মরণে রেখেই মৃত্যুর পর নফরের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্যোগে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশ কিছু ইউরোপীয়ও এ কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। আজও দক্ষিণ কলকাতার চক্রবেড়িয়া রোডে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই স্মৃতিস্তম্ভ। এখন তার ঠিকানা কল্যাণ চক্র অভিযাত্রীর ক্লাব প্রাঙ্গণ। জীর্ণ দশা নিয়ে পরম অবহেলায় পড়ে রয়েছে সেই স্মরণিকা। যেখানে উল্লিখিত হয়েছে এক ‘ছাপোষা’ বাঙালি যুবার সাধারণ জীবনের কিছু অতিসাধারণ তথ্য। যেমন: তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর সন তারিখ (১৮৮১, ২২ মার্চ-১৯০৭, ১২ মে), এন্টালি রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্যপদ গ্রহণ এবং অন্যের হিতকামনায় সর্বদা এগিয়ে আসার মানসিকতা। ব্যাস! এ ছাড়া আর কোনও আলোকোজ্জ্বল তথ্য নেই।
দুই মুসলিম তরুণ সাফাইকর্মীর জীবন বাঁচিয়ে আত্মত্যাগ করেছিলেন যে বাঙালি তরুণ, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি অনেক কিছুর দিশা দেখিয়ে গেছেন। একুশ শতকের হিংসাদীর্ণ, অসহিষ্ণু পৃথিবীতে নফরচন্দ্র কুণ্ডু শুধুমাত্র একটি নাম হতে পারে না। নফর একটি প্রতীক। ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির, চলমান সংঘর্ষের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির প্রতীক।