ডক্টর সৌম্যদীপ রায়।
শেষ আপডেট: 16th September 2024 23:47
৯ অগস্ট আরজি কর হাসপাতালের বুকে জন্ম নেওয়া ডাক্তারদের আন্দোলন আজ দেশের অন্যতম জনআন্দোলনগুলির সঙ্গে একই সারিতে বসেছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনকে করে তুলেছে অনন্য। গড়ে তুলেছে আরও বড় করে। এই আন্দোলনেরই সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে ডাক্তার সৌম্যদীপ রায় জানালেন, আন্দোলনের আসল চরিত্রই হল এটা। যেখানে সাধারণ মানুষ নীতিনির্ধারণের দায়িত্বে না থাকলেও, তাঁদের ঝাঁপিয়ে পড়া অংশগ্রহণে না থাকে কোনও খাদ, না থাকে কোনও শর্ত, না থাকে কোনও স্বার্থ।
তবে এই কথা নিছক তত্ত্বের খাতিরে বলছেন না সৌম্যদীপ। বলছেন, ২০২১ সালে দিল্লির কৃষক আন্দোলনে সামিল হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে। আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা, নর্থবেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করা সৌম্যদীপ তখন ছাত্র ছিলেন। কৃষক আন্দোলনের তীব্রতা যখন চরম পর্যায়ে, সিঙ্ঘু সীমান্তে যখন পুলিশের আক্রমণে একের পর এক কৃষক জখম হচ্ছেন, রক্তাক্ত হচ্ছেন, তখন তিনি সেখানে পরিষেবা দেওয়ার জন্য পৌঁছে গিয়েছিলেন, ছোট্ট টিম গড়ে।
তবে সেখান থেকে অভিজ্ঞতার ঝুলি বোঝাই করে ফেরার সময়ে অবশ্য জানতেন না, বছর তিনেক পরেই ফের আরও এক জন আন্দোলনের সাক্ষী হবেন নিজের রাজ্যে!
তখনকার কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে এখনকার ডাক্তার আন্দোলনের অনেক ফারাক থাকলেও, এক জায়গাতেই এই দুই আন্দোলন মিলে গিয়েছে বলে মনে করেন সৌম্যদীপ। তিনি বলেন, 'দু'ক্ষেত্রেই দেখলাম, সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষদের অংশগ্রহণ একই রকম। এই জায়গা থেকে দুই আন্দোলনের ভাইব একই রকম ভাবে মিলে যায়।'
তিনি বুঝিয়ে বলেন, '৩৮ দিন ধরে চলা ডাক্তারদের এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে। আন্দোলনকে নিঃশর্ত ভাবে ও নিঃস্বার্থ ভাবে সঙ্গ দিচ্ছেন তাঁরা। ডাক্তারদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় রয়েছেন। এই একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল কৃষকদের আন্দোলনেও। এখানে যেমন জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনগুলি আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, নীতি নির্ধারণ করছে, তেমনি সেখানেও কৃষক সংগঠনগুলি ও কৃষক নেতারা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ঠিক করেছিলেন, আগামীর রূপরেখা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল দেখার মতো'
তবে কৃষক আন্দোলনের সময়ে অনেক কঠোর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাঁদের। তিনি বলেন, 'আমরা যখন দেখতে পাই, দিল্লির সিঙ্ঘু বর্ডারে আন্দোলনের স্রোত এগোচ্ছিল, তখন পুলিশ লাঠিচার্জ করে, টিয়ার গ্যাস ছুড়েছিল। আন্দোলন আটকাতে যথেষ্ট বলপ্রয়োগ করেছিল পুলিশ। এটা দেখেই আমরা ঠিক করেছিলাম, ওখানে গিয়ে আহতদের এমার্জেন্সি পরিষেবা দেব। এর পরে যদি কৃষকদের অবস্থানেও দরকার হয় চিকিৎসার, সেটাও মাথায় ছিল আমাদের। এক কথায়, আমরা ইমোশনালি অ্যাটাচড হয়ে পড়েছিলাম।'
এই জায়গা থেকেই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে কৃষক আন্দোলনে গিয়ে পৌঁছেছিলেন সৌম্যদীপরা। এই প্রথম নয়, এর আগেও নানা প্রকৃতিক বিপর্যয়ে, বন্যায়, ঝড়ে নানা জায়গায় চিকিৎসা শিবির করতে গেছেন তাঁরা। তাই দেশের বিপর্যয়েও গিয়ে পৌঁছন দল বেঁধে। তিনি বলেন, 'সিনিয়র ডাক্তার, জুনিয়র ডাক্তার, নার্সরা মিলে মোট ৫ জন গেছিলাম প্রথমে। তখন আমরা বুঝিনি, এত দিন ধরে চলবে এই আন্দোলন। যাইহোক, আমরা ওষুধপত্র নিয়ে যাই, কৃষকদের সঙ্গেই, ওঁদের অবস্থান মঞ্চের পিছনেই তাঁবু করে থাকতাম আমরা। চিকিৎসা পরিষেবা দিতাম।'
সৌম্যদীপ বলেন, 'সে সময়ে আমরা মিলিটারি ক্যাম্প দেখেছিলাম। দেখেছিলাম, কীভাবে কৃষকদের আটকাতে পেরেক পোঁতা ছিল বিভিন্ন জায়গায়, রাখা ছিল বালির বস্তা, দেওয়া ছিল কাঁটাতারের বেড়া। মনে হচ্ছিল যেন এক দেশের সঙ্গে আর এক দেশের বর্ডারে যুদ্ধ বেঁধেছে!'
২০২০ সালের ডিসেম্বরে, দিল্লির ওই কড়া ঠান্ডায় তাঁবু পেতে ২৬ দিন ধরে ছিলেন সৌম্যদীপ ও তাঁর দল। কিন্তু সেটা ছিল সবে শুরু। এর পরে সারা দেশ থেকে চিকিৎসকরা যোগ দেন এই পরিষেবায়। সবাই কয়েক দিন করে এসে থাকতে শুরু করেন। শিফ্ট ডিউটির মতো হয়ে যায় ব্যাপারটা।
তিনি বলেন, 'ডাক্তার হিসেবে বাংলা থেকে আমরাই প্রথম পৌঁছেছিলাম কৃষক আন্দোলনে। পাঞ্জাব ও দিল্লি থেকে কিছু ডাক্তাররা অবশ্য ছিলেন আগে থেকে। ক্যাম্প শুরুর পরে আমাদের ওষুধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল। একদিনেই সব শেষ। আমরা তখন সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন করি ওষুধের জন্য। স্বাস্থ্যভবনের এই আন্দোলনে যেমন সাধারণ মানুষ দিনের পর দিন খাবার, জল, ত্রিপল দিয়ে যাচ্ছেন, সে সময়ে তেমনি ওষুধ দিয়েছিলেন সকলে। ওষুধের অভাব হয়নি কখনও।'
তবে সেই কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে এই ডাক্তারি আন্দোলনের চরিত্রগত ফারাক যথেষ্ট রয়েছে বলে জানান সৌম্যদীপ। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কৃষক আন্দোলন ছিল তাঁদের জীবন-মরণের লড়াই। কৃষিবিল রুখতে তাঁরা প্রাণ পণ করেছিলেন, নইলে আম্বানি-আদানি কর্পোরেট গোষ্ঠীর কাছে তাঁরা বাঁধা পড়ে যেতেন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ত তাঁদের। তাই তাঁরা এত মরিয়া ছিলেন।
তবে ডাক্তারি আন্দোলন অনেক বেশি এথিক্যাল জায়গা থেকে শুরু হয়েছে বলে জানালেন সৌম্য। তিনি বলেন, 'আরজি করে আমাদের জুনিয়র সহপাঠী মেয়েটি যেভাবে মারা গেছেন, তাতে আমরা এটা ভেবেই গলার স্বর তুলতে শুরু করেছিলাম যে এই ধর্ষণ ও খুন নিছক একটা ঘটনা নয়, এর শিকড় গভীরে। আমরা বুঝেছিলাম, কর্তৃপক্ষ লঘু করতে চাইছে বিষয়টাকে। পুলিশও কিছু গোপন করছে। এটা আমরা আটকাতে চেয়েছিলাম। আমরা সত্যিটা তুলে ধরতে চেয়েছিলাম।'
সৌম্যদীপ বলেন, 'আরজি করের ঘটনার গোড়ায় যখন আমরা ঘটনাটা শুনি, এরকম একটা মৃত্যু হয়েছে, তখনই একজন-দুজন করে জড়ো হয় এবং নিজেদের সন্দেহের কথা জানায়, যে কোথাও একটা গন্ডগোল আছে। জুনিয়র ডাক্তাররা তখন দাবি করতে থাকেন, ম্যাজিস্ট্রেট না আসা পর্যন্ত দেহ বেরোতে দেওয়া হবে না। আইনের হস্তক্ষেপ চান তাঁরা। জুডিশিয়াল এনকোয়্যারি দাবি করেন। দাবি করেন, পোস্টমর্টেমের ভিডিওগ্রাফি করতে হবে। প্রথম প্রতিরোধ জুনিয়ররা এভাবেই করতে শুরু করেন।'
তবে এটাও খুব সহজ ছিল না। কারণ, সৌম্যদীপের কথায়, 'আরজি কর এমন একটা জায়গা, সন্দীপ ঘোষের হার্মাদ বাহিনী সেখানে শাসন চালায়। প্রফেসরকে গালাগাল দিতেও আটকায় না তাদের। তারা স্পষ্টতই টিএমসিপি-র সদস্য। এই ভয়ের বাতাবরণে দাঁড়িয়ে পিজিটি-রা যে কিছু করতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। টিএমসিপি-র মাথারা সে সময়ে আমাদের বুঝিয়েছিল, কলেজ কর্তৃপক্ষ বিষয়টা বুঝে নেবে, এত আন্দোলনের কোনও দরকার নেই। তবে সেটা আমরা মেনে নিইনি। ১০ তারিখ যখন খবর পেয়ে সারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ডাক্তাররা পৌঁছন আরজি করে, তাঁদের মারধর করে এই টিএমসিপির দাদারাই। এর পরে আমরা জিবি মিটিং ডাকি, সেটাও ভেস্তে দেওয়া হয়। তবে পরের দিন আমরা 'গাছতলা মিটিং' করি। এটাই ছিল ঐতিহাসিক জিবি। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয়, আমরা কর্মবিরতিতে যাব, শেষ দেখে ছাড়ব। চরম ভয়ের আবহে এই জেদ খুব সহজ ছিল না। এটাই ছিল গেমচেঞ্জার।'
কৃষক আন্দোলনেও এমনই এক বিশেষ মুহূর্ত এখনও ভুলতে পারেননি সৌম্যদীপ। তিনি জানান, কিছু ইয়ং ছেলেমেয়ে এসে বলছিল, ঘুম হচ্ছে না, হজম হচ্ছে না। এরকম বেশ কিছু কেস আসতে থাকে। সবার হিস্ট্রি নিয়ে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, ওরা ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। রিহ্যাবে থাকে, ওষুধ খায়। সেই ওষুধ শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
সৌম্যদীপের কথায়, 'আমরা অবাক হয়ে দেখেছিলাম, সমাজের যারা নেশাখোর বলে চিহ্নিত, তারাও আন্দোলনে আসে! তারা আন্দলনে এসে, নেশার জিনিস না খুঁজে ওষুধ খুঁজছে মেডিক্যাল ক্যাম্পে! তাদের তো কোনও দায় নেই, নেশামুক্তি কেন্দ্র থেকে আন্দোলন করতে আসার। তাও তারা এসেছে। একটা আন্দোলনই বোধহয় মানুষকে এই চেতনা দিতে পারে।'