সঞ্জয় রায়ের নার্কো টেস্ট হবে।
শেষ আপডেট: 13th September 2024 16:42
দ্য ওয়াল ব্যুরো: সালটা ২০০২। গোধরা কাণ্ডে সত্য অনুসন্ধানের জন্য নার্কো পরীক্ষা তথা নার্কো অ্যানালিসিস টেস্টের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সেই প্রথম। এর পরে ২০০৩ সাল। তেলগি স্ট্যাম্প পেপার স্ক্যামে অভিযুক্ত আবদুল করিম তেলগির নার্কো পরীক্ষা করা হয়েছিল। মুম্বই বিস্ফোরণে ধৃত পাক নাগরিক আজমল কাসভেরও নার্কো অ্যানালিসিস টেস্ট করা হয় পরবর্তী কালে। এই নার্কো টেস্টের কথা শেষবার চর্চায় এসেছিল ২০২২ সালে, দিল্লির শ্রদ্ধা হত্যাকাণ্ডে খুনি আফতাবের এই পরীক্ষা করে সত্য জেনেছিলেন তদন্তকারীরা।
এবার আরজি কর কাণ্ডের প্রথম ও একমাত্র অভিযুক্ত, সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের নার্কো টেস্ট করার জন্য অনুমতি চাইল সিবিাই। কিন্তু মেলেনি সেই অনুমতি। কারণ সঞ্জয় নিজে রাজি হয়নি। সূত্রের খবর, অভিযুক্তের বয়ানে যখন অসঙ্গতি থাকে, কিছুতেই যখন সত্যিটা সামনে আসতে চায় না, পুলিশের থার্ড-ডিগ্রিতেও কাজ হয় না, পলিগ্রাফেও সন্তোষজনক তথ্য মেলে না, তখন এই নার্কো পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন তদন্তকারীরা। সঞ্জয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তবে আবেদন খারিজ হয়ে গেল।
আরজি কর হাসপাতালে তরুণী পড়ুয়া-চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের নারকীয় ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা রাজ্য তথা দেশকে। হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায়, সেমিনার রুমে বিশ্রাম নেওয়ার সময়ে ধর্ষণ করা হয় চিকিৎসককে। তার পরে খুন করা হয় নৃশংস ভাবে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে যে সমস্ত আঘাতের কথা জানা গেছে, তাতে রীতিমতো শিউরে উঠতে হয়।
প্রাথমিকভাবে সঞ্জয় এই খুনের কথা স্বীকার করলেও তার বয়ানে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জট ছাড়াতে সিবিআই-কে যথেষ্টই বেগ পেতে হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তদন্তভার হাতে নেওয়ার পর থেকে এক মাসের বেশি সময় কেটে গেলেও তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সিবিআই যথেষ্ট চাপে। তাই নার্কো টেস্ট করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তদন্তকারীরা। তবে আবেদনই মঞ্জুরও হল না।
তবে এই নার্কো পরীক্ষা করানোর আগে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। চাইলেই এই টেস্ট করানো যায় না। পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সাধারণত বড় ধরনের অপরাধেই সন্দেহভাজনকে এই পরীক্ষা করানো হয়। এই টেস্টে অংশ নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত বা অপরাধীকে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে স্থিতিশীল হতে হবে। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, ২০১৬ সালে রবিনসন স্ট্রিটের কঙ্কাল-কাণ্ডে পার্থ দে-কে এই পরীক্ষায় বসানোর কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু তিনি মানসিক ভাবে সুস্থ না থাকায় তা করা হয়নি।
তাই কোনও মামলায় তদন্তকারীরা নার্কো টেস্ট করানোর কথা ভাবলে, তার জন্য আদালতে আবেদন করতে হয়। কেন নার্কো পরীক্ষার প্রয়োজন, কোন পথে তদন্ত এগোচ্ছে, নার্কো পরীক্ষায় আদৌ কোনও লাভ হবে কিনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা কেমন, সব খতিয়ে দেখে তবেই অনুমতি দেওয়া হয়। অভিযুক্তের নিজেরও সম্মতি লাগে। সঞ্জয়ের ক্ষেত্রেও শিয়ালদহ আদালত থেকে এই অনুমতি চেয়েছিল সিবিআই। কিন্তু নারাজ সঞ্জয়।
সহজ করে বললে, অপরাধী বা অভিযুক্তকে এক ধরনের ওষুধ দিয়ে অবচেতনে রাখা হয়। তার চিন্তাভাবনা করার শক্তি হারিয়ে যায়। অনেকটা হিপনোটাইজ করার মতো। সে সময়, অভিযুক্ত মাথা খাটিয়ে বা চিন্তা-কৌশল করে জবাব দিতে পারবে না। তার অবচেতন মনে যা যা আসবে সে সেসবই উত্তর দেবে। আর অবচেতনে সাধারণত সত্যিটাই আসে। এই প্রক্রিয়ায় আসামির থেকে সত্যিটা উগরে নেওয়াই লক্ষ্য থাকে তদন্তকারীদের।
এক ধরনের ইঞ্জেকশন দিয়ে ওই ওষুধ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত অর্ধ-চেতন হয়ে পড়লে, ওই অবস্থায় তাঁর নিজের উপরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তদন্তকারীরা বলেন, সেই সময়ে কোনও ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সঠিক জবাবই দেবে আসামি।
নার্কো পরীক্ষার আগে অভিযুক্তের মেডিক্যাল টেস্ট করা হয়। শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ ফিট দেখার পরেই হিপনোটিক ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। নানারকম হিপনোটিক ড্রাগ আছে। সাধারণত হিপনোটিক সোডিয়াম পেন্টোথাল (Hypnotic Sodium Pentothal) ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। একে বলে থিওপেন্টোন (Thiopentone)। এই ওষুধ শরীরে ঢোকার পরেই মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা করার শক্তি লোপ পায়। অর্ধ-চেতন অবস্থায় পৌঁছয় অভিযুক্ত। তখন তার নিজের চিন্তাভাবনা করার শক্তি থাকবে না। তাই কৌশলে জবাব দিতে পারবে না। মনে করা হয়, ওই অবস্থায় জেরা করলে সত্যি কথাই বলবে অভিযুক্ত বা অপরাধী। তাই এই ধরনের হিপনোটিক ড্রাগকে Truth Drug বা Truth Serum বলা হয়।
আরও কিছু ওষুধ আছে যেমন, স্কোপোলামিন (scopolamine), সোডিয়াম অ্যামাইটাল (sodium amytal)-- এগুলোও প্রয়োগ করেন তদন্তকারীরা। এর পরে হিপনোটিক স্টেজে পৌঁছে যায় অভিযুক্ত। সেই সময় তাকে দিয়ে সত্যিটা বলানোর চেষ্টা করা হয়।
নার্কো পরীক্ষায় অনেক সময়েই অভিযুক্তের বয়ানের অসঙ্গতিগুলো ধরতে পারেন তদন্তকারীরা। সত্যি সামনে আসে বা এসেছে অনেক ক্ষেত্রেই। কিন্তু সবক্ষেত্রে এই পরীক্ষা সফল হয় না। ২০০৭ সালে হায়দরাবাদে জোড়া বিস্ফোরণে অভিযুক্ত আবদুল কালিম ও ইমরান খানের ওপর নার্কো পরীক্ষা হয়েছিল, তাতে খুব একটা সুফল মিলেছিল বলে জানাননি তদন্তকারীরা। আবার ২০০৫ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজনদের নার্কো পরীক্ষা করিয়েও তেমন কোনও তথ্য পাননি তদন্তকারীরা।
মুম্বই বিস্ফোরণে ধৃত পাকিস্তানের জঙ্গি আজমল কাসভেরও নার্কো পরীক্ষা করানো হয়েছিল। হাই প্রোফাইল কেসগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে কুরলায় ৯ বছরের একটি মেয়েকে ধর্ষণে অভিযুক্ত মহম্মদ আমেরি শেখের নার্কো পরীক্ষা করিয়েছিলেন তদন্তকারীরা। অপরাধীর বয়ানে বিস্তর অসঙ্গতি ছিল। ওই পরীক্ষার পরে অপরাধীর বয়ান নিয়ে নতুন করে তদন্তপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যান অফিসাররা। ২০১২ সালে দিল্লির একটি হত্যাকাণ্ডেও নার্কো টেস্টের অনুমতি দিয়েছিল আদালত। সেটাও ছিল হাই-প্রোফাইল কেস। দিল্লির ব্যবসায়ী অরুণ টিক্কুকে খুন করা হয়েছিল লোখাণ্ডওয়ালায়। অভিযুক্ত বিজয় পালান্ডের থেকে সত্যিটা বের করতে এই পরীক্ষা করেছিলেন তদন্তকারীরা। ২০২২ সালে দিল্লির তরুণী শ্রদ্ধাকে কুপিয়ে ফ্রিজে ভরে রাখার ঘটনায় নার্কো টেস্টেই সমস্ত সত্যিটা বলেছিল তাঁর লিভ ইন সঙ্গী আফতাব।
এই নার্কো অ্যানালিসিস টেস্ট নিয়ে দ্বিমত আছে। অনেকেই বলেন, এই পরীক্ষা করা মানে জোর করে হিপনোটিক ড্রাগ দিয়ে অর্ধ-চেতন করে দেওয়া হয়। তারপর সেই অবস্থাতেই জাগিয়ে রেখে জেরা করার জন্য শরীর ঝাঁকানো, চড়-থাপ্পড় মারা, শরীরে আঘাত করা-সহ নানারকম পদ্ধতি নিয়ে থাকেন তদন্তকারীরা। অবচেতনে থাকার সময় বলা কথাও যে সব ঠিক হবে তা নয়। তাই এই পরীক্ষা সত্যি সামনে আনার একমাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয় বলেই মনে করা হয়।