শেষ আপডেট: 25th October 2024 16:31
খুনের অভিযুক্তকে সাজা করাতে গেলে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণের মালা গেঁথে মুখ বেঁধে দিতে হয়। যাতে সে তা ভেদ করে বেরিয়ে না আসতে পারে। আরজিকর হাসপাতালের মহিলা চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে সিবিআই চার্জশিট দেওয়ার পর লালবাজার এক দুঁদে গোয়েন্দা এই মন্তব্য করেছিলেন।
তরুণী চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের প্রায় ৫০ জন অফিসার ৯৬ ঘণ্টার তদন্তের কাজ করে যে মালা গেঁথেছিলেন, সিবিআই চার্জশিটে সেই মালাই সঞ্জয়কে পরিয়েছে। শুধু ৯৬ ঘণ্টায় কয়েকটি রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষা ছিল। বাকি সবটাই করে দিয়েছিল লালবাজার।
বিধাতার পরিহাস। সেই খুন ও ধর্ষণের ঘটনার তদন্তভার হাইকোর্টের নির্দেশে চলে যায় সিবিআইয়ের হাতে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছে এই মন্তব্য করতে শুনেছি যে, তিনটি কারণে হাইকোর্ট সম্ভবত এই মামলা সিবিআর হাতে তুলে দিয়েছে।
প্রথমত, সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতারের পর পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল যে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন, সেখানে তিনি সঞ্জয় যে সিভিক ভলান্টিয়ার সেই পরিচয়টা তিনি বলতে চাননি। দ্বিতীয়ত, নির্যাতিতার বাড়িতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকে তদন্তের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। সেই সময়ের মধ্যে পুলিশ তদন্ত সম্পন্ন করতে না পারলে মামলা সিবিআই কে তুলে দেবেন বলেছিলেন। ফলে পুলিশি তদন্তের উপরই তিনি প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছিলেন। তৃতীয়ত, আরজি কর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষকে অনেক বিতর্কের পরেও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ করা আদালত ভাল চোখে দেখেনি। আদালতের মনে সন্দেহ তৈরি হওয়ায় এই তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে চলে যায় বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত।
চার্জশিটের বাইশ নম্বর পাতায় সিবিআই সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণের যে ১১টি কারণ উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে--
শুধু এই ১১টি প্রমাণ নয়, প্রধান অভিযুক্ত সঞ্জয় ঘটনার আগের দিন দুপুরে সল্টলেকের চতুর্থ ব্যাটেলিয়ানের ব্যারাক থেকে বেরিয়ে থেকে ঘটনার পরদিন ভোরবেলা চতুর্থ ব্যাটেলিয়ানে পৌঁছনো পর্যন্ত প্রায় ১৬-১৭ ঘণ্টা তার গতিবিধির সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছিল কলকাতা পুলিশ। যা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সিবিআই চার্জশিটের ১৪ পাতায় তা উল্লেখ করেছে।
ঘটনার আগের দিন দুপুরে সঞ্জয় আরেক সিভিক ভলান্টিয়ার সৌরভ ভট্টাচার্যকে নিয়ে মোটরবাইকে চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাক থেকে আরজিকর হাসপাতালে পৌঁছয়। সেখান থেকে তারা যায় শোভাবাজার এলাকায়। শোভাবাজার এলাকায় তারা মদ্যপান করে। এরপর সৌরভ ব্যারাকে ফিরে যায়। সঞ্জয় ফের আরজিকর হাসপাতালে আসে। রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ সৌরভ ফের আরজিকর হাসপাতালে পৌঁছয়। সেখান থেকে তারা মোটরবাইকে চেপে চেতলা এলাকার একটি যৌনপল্লিতে যায়। এক যৌনকর্মীর ঘরে ঢোকে সৌরভ। সঞ্জয় সেখানে মদ্যপান করে। রাত ৩টে কুড়ি মিনিট নাগাদ তারা ফের আরজি কর হাসপাতালে পৌঁছয়। সৌরভ হাসপাতাল থেকে ব্যারাকে চলে যায়।
এরপর সঞ্জয় প্রথমে জরুরি বিভাগের বিল্ডিংয়ের দোতালায় যায় এক রোগীর বিষয়ে খোঁজ নিতে। তারপরে যায় পাঁচতলায়। এর পরে আসে চারতলার সেই সেমিনার রুমে। সেখানে ধর্ষণ-খুনের ঘটনা ঘটিয়ে সে ফের চতুর্থ ব্যাটেলিয়নে ভোর পাঁচটা নাগাদ ফেরে। আগের দিন দুপুর থেকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত সঞ্জয় মোটরবাইক নিয়ে যে যে রাস্তা দিয়ে গিয়েছে, ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে সমস্ত ফুটেজ সংগ্রহ করেধ লালবাজারের তদন্তকারীরা। হাসপাতালে দুপুরে এবং গভীর রাতে ঢোকার পর থেকে বেরোনো পর্যন্তও সমস্ত ফ্লোরের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেন। কলকাতা পুলিশের অফিসাররা সবটাই তুলে দিয়েছেন সিবিআইয়ের হাতে। চার্জশিটে তারই প্রতিফলন রয়েছে।
এই ঘটনায় কলকাতা পুলিশের তদন্তকারী দলের (সিট) এক অফিসার জানিয়েছেন, ৯৬ ঘণ্টার মধ্যে এত নিখুঁত তদন্ত কবে কলকাতা পুলিশ করেছে, তা তিনি স্মরণ করতে পারছেন না। আসলে প্লেটে খাবার সবটাই সাজানো ছিল। শুধু পরিবেশনটাই করল সিবিআই।