কাশ্মীর থেকে তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

পর্যটকদের জন্য কাশ্মীরের দরজা খুলেছে সবে এক সপ্তাহ হল। তার আগে দু'মাস বিচ্ছিন্ন ছিল উপত্যকা। ছিল নানা অশান্তি, সমস্যা, যার খুব কম অংশই হয়তো বাইরের দুনিয়ায় পৌঁছেছে। অপরিবর্তিত ভাবে। কিন্তু আশার কথা হল, হাতে গোনা হলেও পর্যটকের দল আসতে শুরু করেছে এখানে সাহস করে। এটাই বোধহয় কাশ্মীরের ম্যাজিক। আর সেই ম্যাজিকে সব চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাঙালিরাই!
যেমন বলছিলেন চুঁচুড়ার কৃষ্ণচন্দ্র দাস। কাশ্মীরের অন্যতম সুন্দর এক জায়গা গুলমার্গের বুকে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, কয়েক বছরের স্বপ্ন ছিল ভূস্বর্গ ভ্রমণ। নানা পরিকল্পনার পরে এ বছর সেই স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে এগিয়েছিল। মাস কয়েক আগে কাশ্মীরেরই এক ট্র্যাভেল এজেন্টের সাহায্যে ব্যবস্থা করেন সব কিছু। কিন্তু অগস্টের শুরুতে আচমকা ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের ঘটনায় মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। একা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু নন, তাঁরা যে ৪৬ জন মিলে এই ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁদের সকলেরই।
[caption id="attachment_151741" align="aligncenter" width="650"]
ব্যান্ডেলের বিশ্বাস পরিবার[/caption]
"সবাই একে একে ক্যানসেল করে দিল প্রোগ্রাম। হতাশা, ভয় মিশিয়ে কেউ আর এগিয়ে এল না। ঝুঁকি নিতে চাইল না। শেষ অবধি থেকে গেছিলাম আমরা ১৫ জন।’’ বলছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রবাবু। ১০ অক্টোবর পর্যটকদের জন্য খুলে যায় কাশ্মীর। আর দেরি না করে, বুক ঠুকে চলে আসেন তাঁরা। ভদ্রেশ্বর, ব্যান্ডেল, চুঁচুড়া মিলিয়ে তিন-চারটি পরিবার এসে পৌঁছন উপত্যকায়। ভয় কি ছিল না? কোনও দুশ্চিন্তা কি হয়নি? হয়েছে সবই। বাইরে থেকেও ভয় দেখিয়েছেন অনেকে। কিন্তু সেসব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছে ওঁদের ইচ্ছে।
আরও পড়ুন: গুলমার্গ বিষণ্ণ, বন্ধ ব্যবসা, কাশ্মীর ভাবছে শীতে খাব কী
তবে এই ইচ্ছেতে সবচেয়ে বেশি জোর জুগিয়েছেন কাশ্মীরের ট্র্যাভেল এজেন্ট। মোবাইল পরিষেবা চালু হওয়ার পর থেকেই যোগাযোগ করেছেন তাঁদের সঙ্গে। একটানা ভরসা জুগিয়ে গেছেন, কোনও অসুবিধা হবে না। পর্যটকদের নিরাপত্তা তাঁর নিজের। কোথাও কোনও সমস্যা হলে, তিনি নিজে সমাধান করবেন, আঁচ লাগতে দেবেন না পর্যটকদের গায়ে। বারবার করে আশ্বাস দিয়েছেন, উপত্যকায় রাজনৈতিক সমস্যা যা-ই হোক না কেন পর্যটকদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত কাশ্মীর। কারণ সব কিছুর পরে, এখানকার একটা বড় অংশের মানুষের রুটি-রুজির জোগান দেয় এই পর্যটনই।

কাশ্মীরি সেই এজেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ কৃষ্ণচন্দ্রবাবুর স্ত্রী মিনতিদেবীও। "সব রকম ব্যবস্থা করছে ওরা। এখনও কোনও অসুবিধা হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা, অনেক সস্তায় সব কিছু পাচ্ছি। ভিড়ভাট্টা নেই, শান্তিতে ঘুরছি। রাস্তায় প্রচুর সেনা রয়েছেন, ভরসা জোগাচ্ছেন তাঁরাও।" বলছিলেন তিনি।
শ্রীনগরে এখনও খোলেনি হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানবাজার। কিন্তু খুলে গিয়েছে হাউসবোটগুলি। হাউসবোট ইউনিয়নের সদস্য মিনহাজ আব্বাস জানালেন, সাধারণত এটাই ট্যুরিস্টদের পিক সিজ়ন। সব চেয়ে চড়া রেট থাকে এই সময়েই। কিন্তু এখন অর্ধেকেরও কম রেটে পাওয়া যাচ্ছে হাউসবোট। শিকারা চেপে ডাল লেকে ঘোরার ভাড়াও অর্ধেকেরও কম। পর্যটকদের জন্যও গাড়ির রেটও প্রায় অর্ধেক। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা যে পশমিনা শাল বা কাঠের শো-পিস বিক্রি করেন, তার দামও অনেকটাই কম এখন। এমনকি খাবার তৈরির দায়িত্বও নিচ্ছে হাউসবোটগুলিই। বাইরের কোনও খাবারের দোকান খোলা না থাকলেও কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
বাঙালি পর্যটকরা আসতে শুরু করলেও, গতকাল পহেলগাঁওয়ে গিয়ে অবশ্য কারও সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে সেখানকার স্থানীয় গাইডরাই জানালেন, দু'-তিন দিন হল দু’একটি পর্যটকের দল আসতে শুরু করেছেন বেড়াতে। দু'মাসের খরার পরে, একটু একটু করে রোজগার শুরু করেছেন গাইডরা। সেই সঙ্গে তাঁরা এও মনে করিয়ে দিলেন, যাঁরা আসছেন সকলেই বাঙালি। দেশের অন্য কোনও পর্যটক দল এখনও কাশ্মীরে এসে পৌঁছননি।

তবে দেশের অন্য কেউ না এলেও, বৃহস্পতিবারই মালয়েশিয়া থেকে ১৪ জন পর্যটকের একটি দল এসে পৌঁছেছে শ্রীনগরে। তাঁদের স্থানীয় গাইড কাদির ইকবাল জানালেন, তিনি ভেবেছিলেন, এই অবস্থায় হয়তো এই দলটিও আসবে না। এর আগে তাঁর ৫-৬টি দলের সঙ্গে চুক্তি ছিল, যাঁরা বাতিল করেছেন ট্যুর। কিন্তু ১০ তারিখে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরেই মালয়েশিয়ার এই দলের তরফে জানানো হয়, তাঁরা আসছেন। কাদিরও যতটা সম্ভব আশ্বস্ত করেছেন তাঁদের। ওই দলের সদস্যরা জানালেন, এত ফাঁকায়, এত শান্তিতে কাশ্মীর ঘুরতে পেরে খুব খুশি তাঁরাও। ভয় বা আতঙ্কের কোনও পরিস্থিতি এখনও হয়নি।
[caption id="attachment_152431" align="aligncenter" width="1152"]

উপত্যকায় মালয়েশিয়ান পর্যটক দল।[/caption]
দোকানপাট সব খোলেনি ঠিকই। রেস্তোরাঁ বা হোটেলগুলি বন্ধ, সেটাও ঠিক। কিন্তু একইসঙ্গে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরাই বলছ্নে, পর্যটক বাড়লেই দোকান খুলবেন তাঁরাও।
বাঙালি বা মালয়েশিয়ান, দুই পর্যটক দলের সদস্যরাই বলছেন, স্থানীয় মানুষদের যত্ন এবং সেনাদের তৎপর প্রহরা-- এই দুই মিলে পর্যটকদের জন্য যেন এখনই সব চেয়ে বেশি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে কাশ্মীর।

বৃহস্পতিবার রাতভর বৃষ্টি হয়েছে কাশ্মীরে। নতুন করে বরফ পড়েছে সোনমার্গে। একঝটকায় অনেকটা নেমে গিয়েছে তাপমাত্রা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শীতের প্রস্তুতি শুরু করে দিল প্রকৃতি। এই সময়টায় ভূস্বর্গ যেন আরও মোহময়, আরও সুন্দর। ইতিউতি বরফের সাজে অনন্য হয়ে ওঠে সে এ যেন পর্যটকদেরই আরও এক বার মনে করিয়ে দেওয়া, ভূস্বর্গ তাঁদেরই অপেক্ষায় রয়েছে।
আরও পড়ুন:
https://www.four.suk.1wp.in/news-jammu-and-kashmir-internal-trade-affected/
পড়ুন, দ্য ওয়ালের পুজোসংখ্যার বিশেষ লেখা...
https://www.four.suk.1wp.in/pujomagazine2019/%e0%a6%aa%e0%a7%81%e0%a6%b0%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b0%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%9c%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%af-%e0%a6%86%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%b8%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%87/