রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার।
শেষ আপডেট: 6th December 2024 18:47
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পশ্চিমবঙ্গের তদন্তের ইতিহাসে জয়নগর মামলার তদন্ত (Jaynagar Investigation) ও বিচারকে ‘নজিরবিহীন’ বলে দাবি করছে পুলিশ। সে দাবিকে খারিজ করে দিতে পারছে না কোনও মহলই। কারণ নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুনের মতো ঘটনায় মাত্র ৬২ দিনের মাথায় সাজা ঘোষণা, আক্ষরিক অর্থেই বেনজির।
আজ, শুক্রবার বারুইপুর জেলা এবং দায়রা আদালতের অধীন পকসো কোর্টে অভিযুক্ত মুস্তাকিন সর্দারের ফাঁসির সাজা ঘোষণা হওয়ার পরে বিকেলে এই ঘটনার তদন্তের কথা বিস্তারিত রাজ্য পুলিশ। ফেসবুক লাইভ করেন রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার (Supratim Sarkar)।
সেখানেই তিনি সকলকে বুঝিয়ে বলেন, এই জয়নগর তদন্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রমাণের উপর ভিত্তি করে চার্জশিট খাড়া হয়েছে, সেটির কথা। তিনি বলেন, প্রমাণ হিসেবে এই বিষয়টি সচরাচর ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে করা হয়েছে। সেটি হল, ‘গেট প্যাটার্ন অ্যানালাইসিস’ (Gait Pattern Analysis)। সুপ্রতিম সরকারের কথায়, ‘প্রতিটি মানুষের হাঁটা, দৌড়োনো, সাইকেল চালানো, বাইক চালানো—এই সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র ছন্দ থাকে। ইউনিক লোকোমোটিভ বিহেভিয়ার থাকে প্রত্যেকের। এটাকেই বলা হয় গেট প্যাটার্ন।’
সুপ্রতিম বুঝিয়ে বলেন, ‘এই কেসের তদন্তে আমরা অভিযুক্ত মুস্তাকিন সর্দারের গেট প্যাটার্নকে খুব ভাল করে বিশ্লেষণ করেছি। কীভাবে? আমরা তিনটে গুরুত্বপূর্ণ ফুটেজ পেয়েছিলাম। একটা হল, পাশে সাইকেল নিয়ে মুস্তাকিন হাঁটছে। আরেকটা ফুটেজে সে সাইকেলে চড়ছে, আরেকটিতে, সে মেয়েটির পিছু নিচ্ছে।’
রীতিমতো রহস্যকাহিনির পাতা উল্টোনোর মতোই সুপ্রতিম বলে চলেন, ‘বারুইপুর সংশোধনাগারে যখন মুস্তাকিন ছিল, তখন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ ও জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মুস্তাকিনের গেট প্যাটার্ন অ্যানালাইসিস করা হয়। ওই একই সাইকেলে তাকে চড়ানো হয়, পাশে নিয়ে হাঁটানো হয় এবং তাকে বলা হয় সাইকেল চালাতে। পুরো প্রক্রিয়ার ভিডিওগ্রাফি হয়। সেই ভিডিও এবং সিসিটিভি ফুটেজ আমরা ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠাই বিশ্লেষণের জন্য। তাঁরা সেসব খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেন, দুটো ক্ষেত্রেই গেট প্যাটার্ন মিলে গেছে। দুজন একই ব্যক্তি।’
দেখুন, কী বলেছেন সুপ্রতিম সরকার।
সুপ্রতিম সরকার জানান, এই সমস্ত তথ্যপ্রমাণ একসঙ্গে করেই চার্জশিট জমা দেওয়া হয় ঘটনার ২৫ দিনের মাথায়। এর পরে ৬২ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করে সাজা ঘোষণা।
এত দ্রুত ও তৎপর তদন্ত এবং সেই সঙ্গেই নাতিদীর্ঘ বিচার শেষে সাজা ঘোষণা—ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় বিরলই বলা চলে। এর আগে সারা দেশেই এই ধরনের বহু মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বারবার সমালোচনার মুখে পড়েছে। এমনকি গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া নির্ভয়া কাণ্ডের সময়েও ‘তারিখ পে তারিখ’ ঘোষণার ক্ষোভ মানুষের মুখে মুখে ঘুরত।
জয়নগরের আজকের রায় যেন এই সব কিছুর একটা বড় উত্তর হিসেবে পৌঁছল মানুষের কাছে। বার্তা দিল, বিচার মোটেও অধরা নয়। অপরাধের শাস্তি সময়েই মেলে। দরকার শুধু তৎপরতা।
ঘটনাটি ঘটেছিল ৪ অক্টোবর। বারুইপুর পুলিশ জেলার জয়নগর থানার মহিষমারি এলাকায় দশ বছরের এক নাবালিকার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। অভিযোগ ওঠে, মেয়েটির প্রতিবেশী, ১৯ বছরের যুবক মুস্তাকিন সর্দার নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে, গলা টিপে খুন করেছে তাকে।
তদন্ত শুরু হয় যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ৫ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয় অভিযুক্তকে। সিট গঠন করে তদন্তও শুরু হয় ৭ তারিখ থেকে। নেতৃত্বে বারুইপুর পুলিশ জেলার এস.পি পলাশ ঢালী।
এর পরে চার্জশিট জমা পড়ে ঘটনার ২৫ দিনের মাথায়, ৩০ অক্টোবর। এতটুকু সময় নষ্ট না করে, বিচার শুরু হয় ৫ নভেম্বর। মাত্র ২১ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হয় বিচারপ্রক্রিয়া।
আজ, ৬ ডিসেম্বর, সেই ঘটনার ঠিক ৬২ দিনের মাথায় সাজাও ঘোষণা হয়ে গেল অভিযুক্তর। ফাঁসির আদেশ দিলেন বারুইপুর জেলা এবং দায়রা আদালতের অধীন পকসো কোর্টের মাননীয় অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জাজ সুব্রত চট্টোপাধ্যায়।