শেষ আপডেট: 8th May 2023 10:14
গলায় গেরুয়া উত্তরীয়। কপালে শ্বেত চন্দনের প্রলেপ। মাথায় পাগড়ি। লম্বা দাড়িতে এমনিতেই প্রধানমন্ত্রীর সাধু সাধু লুক। সেদিন অর্থাৎ ২ মে মঙ্গলবার তাঁকে ভাষণ দিতে ডাকার পর প্রধানমন্ত্রী প্রথমে মাইক্রোফোন হাতে নিলেন না। গলায় ঝুলিয়ে নিলেন মঞ্চে হাজির বাজনদারদের একজনের ঢোলটি। মিনিট পাঁচ-সাত শরীর দুলিয়ে ঢোল বাজিয়ে মাইক্রোফোন ধরলেন তারপর। চমক সেখানেও। মাইক ধরেই প্রধানমন্ত্রী ‘বজরংবলী কি’ (Jai Bajrang Bali) বলে টানা ছ’বার স্লোগান দিলেন।
ভাষণের শুরুতে মোদীর মুখে নতুন স্লোগান শুনে গোড়ায় অনেকেই চমকে গিয়েছিলেন। খানিক পরেই বাকিরা বুঝে যান, নরেন্দ্র মোদী কেন ভাষণ শুরুর চেনা স্লোগান বদলে নিয়েছেন। সেই দিন থেকে ‘বজরংবলী কি জয়ধ্বনিতে মুখরিত কর্নাটকের ভোটের (Karnataka election) প্রচার। মোদী তথা বিজেপির সভা, রোড শো তো আছেই, বাদ যায়নি কংগ্রেসও। বজরংবলীকে হাতিয়ার করে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের জবাব দিতে দিতে কংগ্রেস নেতাদের মুখে ফেনা ওঠার জোগার। দলের কথা বলা থেকে মোদীর অভিযোগের জবাব দিতে দিতেই সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ভাষণের অভিমূখ বদলাতে হয়েছে মল্লিকার্জুন খাড়্গে, রাহুল, প্রিয়ঙ্কা, ডিকে শিবকুমার, সিদ্দারামাইয়াদের।
২ মে’র আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী দলের সভায় মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে প্রথমে বলতেন, তিন থেকে ছয়বার সুর করে বলতেন ‘ভারতমাতা কি’। শ্রোতা-দর্শকেরা ‘জয়’ বলে গলা মেলাতেন। জমায়েত থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ (jai Shree Ram) ধ্বনিও শোনা যেত। ক্রমে সেই ধ্বনিতেও মুখরিত হত সমাবেশ স্থল। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য ভারতমাতা….তেই থেমে থেকে সভা শান্ত হলে ভাষণ শুরু করতেন। কর্নাটকে গত সাতদিন ছবিটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভারতমাতা, শ্রীরামচন্দ্রের তুলনায় বজরংবলী অর্থাৎ হনুমানের নামে জয়ধ্বনি আর ছবির ছড়াছড়ি। এমনকী মোদী মুখোসের জায়গা নিয়েছে হনুমান-মুখোস।
ভারতমাতার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু আরএসএস, জনসংঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা-সহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের একেবারে গোড়াকার সংস্কৃতি। ৪৪ বছর আগে বিজেপিও সেই সংস্কৃতি আঁকড়েই হিন্দুদের পার্টি হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছিল। গত শতকের নয়ের দশকের গোড়া থেকে পরের তিন দশক রাম মন্দির আন্দোলনের সুবাদে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানে অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছিল ভারতমাতার নামে জয়ধ্বনি। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আবার ‘ভারতমাতা কি জয়’ কার্যত বাধ্যতামূলক করেছেন বিজেপির সভা-সমিতিতে। যেমন দলের টুপি সম্পর্কে বাকিদের আগ্রহী করতে নিজে নিয়ম করে তা পরছেন ইদানীং।
বলতে গেলে একটা সময় পর্যন্ত ‘ভারতমাতা কি জয়’ ধ্বনি ছিল হিন্দুত্ববাদীদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার একমাত্র ভরসা। কিন্তু বিজেপির ক্ষমতার অলিন্দে পা রাখা, সারা দেশে দলের বিস্তারে পাইলট কারের কাজ করছে জয় শ্রীরাম ধ্বনি। কর্নাটকে চলতি নির্বাচনী লড়াইয়ের মঞ্চে বিজেপির পাইলটকার কিন্তু ‘বজরংবলী’।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বজরং দল আগামী ৯ মে মঙ্গলবার দেশ জুড়ে হনুমান চালিশা পাঠের ডাক দিয়েছে। পরদিন বুধবার কর্নাটকে ভোট গ্রহণ। উদ্দেশ্য ভোটদানের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বজরংবলীর স্মৃতি ভোটারের মনে জাগিয়ে রাখা। ভোটকেন্দ্রের চারপাশও ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বজরংবলীর ছবিতে। বড় রাস্তার মোড়ে বসেছে হনুমানের কাটআউট, ফ্লেক্স। হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছে হনুমান চালিশার পাতা, সমাজমাধ্যম ভরে গিয়েছে রাম ও রামভক্ত অনুমানের ছবি আর কাহিনিতে।
এত কিছুর মূলে আছে কংগ্রেসের ইস্তাহার। ২ মে মঙ্গলবার সকালে ইস্তাহার প্রকাশ করে তারা ঘোষণা করে, ক্ষমতায় এলে তাদের সরকার ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। দৃষ্টান্ত হিসাবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দল আর ইসলামপন্থী পিএফআইয়ের নাম উল্লেখ করে কংগ্রেস।
সেদিনই কয়েক ঘণ্টা পর কর্নাটকে পা রাখেন প্রধানমন্ত্রী। পয়লা সভাতেই হাতিয়ার করেন বজরং দল নিয়ে কংগ্রেসের ঘোষণাকে। যদিও সন্তর্পণে সংগঠনটির নাম এড়িয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মুখে ঘুরে ফিরে আসে শুধু ভগবান বজরংবলী অর্থাৎ হনুমানের নাম।
কথিত হল পবনপুত্র হনুমানের জন্ম কর্নাটকের উত্তর কন্নড় জেলার গোকর্ণে৷ দুয়ে দুয়ে তাই চার করতে কালক্ষেপ করেননি মোদী। একে তো ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা রামভক্ত হনুমানের পরম ভক্ত। তার উপর পবনপুত্রের জন্ম কর্নাটকেই, বিশ্বাস করেন রাজ্যবাসী। ফলে হনুমান ভগবানকেই কর্নাটকের ভোটের দল ও তাঁর নিজের স্বার্থে নয়া অস্ত্র করে নেন প্রধানমন্ত্রী। বলতে গেলে ম্যাচ এতটাই ঘুরিয়ে দেন, যে ফুটবল ম্যাচে প্রতিপক্ষকে রাগবি খেলতে বাধ্য করেছেন।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যুব শাখা বজরং দলের প্রসঙ্গ এড়িয়ে পয়লা সভাতেই কংগ্রেসের ঘোষণাকে গুলিয়ে দেন মোদী। জনসভায় অভিযোগ করেন, ‘কংগ্রেস ইস্তাহারে বলেছে, বজরংবলীকে তালাবন্ধ করবে। হিন্দু দেবতার প্রতি এই হল কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গি।’ শতাব্দী প্রাচীন দলটিকে সরাসরি হিন্দু বিরোধী বলেও দেগে দেন প্রধানমন্ত্রী। সভার পর সভায় ভাঙা রেকর্ডের মতো গত কয়েকদিন এই এক কথা বলে গিয়েছেন তিনি। বাদ যায়নি রোড শো। তাতে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি মানুষের দৃষ্টি আবদ্ধ ছিল হনুমান সেজে আসা লোকেদের দিকেও।
মোদী মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো তাঁদেরই ইস্তাহারকে হাতিয়ার করেছেন বুঝে কংগ্রেস নেতারা ব্যাখ্যা দিতে আসরে নামেন। দলের তরফে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মিথ্যাচার করছেন। কংগ্রেস আদৌ বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার কথা বলেনি। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি গোটা প্রচারটাকেই বজরংবলী সর্বস্ব করে তোলে। বিপদে পড়ে কংগ্রেস নির্বাচন কমিশনে প্রধানমন্ত্রীর নামে নালিশ ঠুকেছে। শিবমোগ্গার সভায় প্রধানমন্ত্রী সরাসরি অভিযোগ করেন, ‘কংগ্রেস তলে তলে জঙ্গিদের মদত দেয়।’ কমিশনের কাছে থেকেও সুবিচার মেলেনি কংগ্রেসের। মোদী জমানার ধর্ম মেনে কমিশন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি এখনও।
এসবের মধ্যে কংগ্রেসের অন্দরে অন্য আলোচনাও আছে। ইস্তাহারে বজরং দলের নামটি উল্লেখ করে বিজেপির হাতে দলই এই অস্ত্র তুলে দিয়েছে, মনে করছেন কংগ্রেসের একাংশ। কংগ্রেস নেতৃত্বের যদিও ব্যাখ্যা, ভোটের পরিণতি যাই হোক, এটাই দলের নীতিগত অবস্থান। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীশগড়, তেলেঙ্গানার আসন্ন বিধানসভা ভোটেও এই ঘোষণাকে সামনে রেখে দল লড়াই করবে। দলের ব্যাখ্যা, কংগ্রেসের বাইরে থাকা উদারপন্থী ভোটারদের সমর্থন পেতেই এই কৌশল। ১৩ মে ফল ঘোষণার পর জানা যাবে কংগ্রেস, নাকি নরেন্দ্র মোদী, কার কৌশল ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয়েছে।
চণ্ডীপুরের দুর্ঘটনার তদন্ত করুক সিবিআই, হাইকোর্টে মামলা করে আর্জি শুভেন্দুর