মহম্মদ ওসমান ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: 9th August 2024 19:13
দিন কয়েক আগে পাম অ্যাভিনিউর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভাবলাম এত কাছেই যখন এলাম, বুদ্ধদাকে একবার দেখে যাই। পার্টির সাধারণ কর্মী থেকে মন্ত্রী, উপমুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী থেকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী—বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর এই লম্বা সফরের মধ্যে দীর্ঘ ৩৫ বছর টানা তাঁর সঙ্গে আমি কাটিয়েছি। ১৯৮২ থেকে ২০১৬, তাঁর গাড়ির চালক ছিলাম। সামনাসামনি ‘বুদ্ধদা’ বা ‘স্যার’, এসব কিছুই সম্বোধন করতাম না। কিন্তু অন্যদের সঙ্গে কথায় ওঁর প্রসঙ্গ এলে আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বরাবর ‘বুদ্ধদা’ বলে উল্লেখ করতাম। উনি আমাকে বরাবর ‘আপনি’ বলে সম্ভোধন করতেন। সেদিনও, পাম অ্যাভিনিউর বাড়িতে অসুস্থ মানুষটা আমাকে এই বলে বিদায় জানালেন, ‘আমি ভালো আছি। আপনি ভালো থাকবেন।’
২০১৬-তে সরকারি গাড়ির চালকের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বুদ্ধদার সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ কমে গিয়েছিল। অসুস্থতার জন্য বেরোতেন না। আমি অবসর নেওয়ায়, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ওঁর জন্য বরাদ্দ সরকারি গাড়িটাও আমার আর চালানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু ওঁর সঙ্গে কাটানো দিনগুলিই আমার মনের মধ্যে সদা ভিড় করে। আমি নিজেকে ধন্য মনে করি, ওঁর মতো মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি। ওঁর সাহচর্যই আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকে বুঝতে শিখিয়েছে, ক্ষমতা অর্জন তেমন কঠিন কিছু নয়। সৎ থাকাটা অনেক বড় সংগ্রাম।
একদিনের কথা বলি, উনি কাউকে বলছিলেন, ‘সততার পথ কঠিন এবং দীর্ঘ। অসততা করে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না।’ কথাটা আমার মনে ও মাথায় গেঁথে আছে। তাই প্রতিদিন খেয়াল রেখেছি, এমন কিছু করব না, যা থেকে ওঁর অসম্মান হতে পারে, ওঁর গায়ে কেউ কালি ছেঁটাতে পারে। আমি মনে করি, বুদ্ধদাকে মানুষ মনে রাখবেন ক্ষমতার চূড়ায় আসীন হয়েও জীবনযাত্রায় সহজ, সরল এক সৎ রাজনীতিক হিসাবে।
সিপিএমের রাজ্য দপ্তরে আমি বহু বছর নেতাদের গাড়ি চালিয়েছি। প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখার্জি, শৈলেন দাশগুপ্ত, আবদুল্লা রসুল, সমর মুখার্জি, সুধাংশু দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাসদের মতো মানুষদের নিয়ে কত কত জায়গায় গিয়েছি। ’৮৭-বিধানসভা ভোটে বুদ্ধদা ফের জিতে মন্ত্রী হলেন। তার আগে থেকেই আমি ওঁর জন্য বরাদ্দ পার্টির গাড়ি চালাতাম। সরোজদা তখন পার্টির রাজ্য সম্পাদক।
মন্ত্রী হওয়ার পর বুদ্ধদা একদিন সরোজদাকে বললেন, ওসমানকে আমি সঙ্গে রাখতে চাই। সরোজদা বললেন, সেটা কী করে হবে। পার্টির জন্য আমরা ওকে নিয়েছি। সরকারি জায়গায় চলে গেলে কী করে হবে। সত্যি কথা বলতে, কী আমিও বুদ্ধদার সঙ্গ ছাড়তে চাইতাম না। কিন্তু কাউকে বলতে পারিনি। বুদ্ধদা আমাকে নিজের সঙ্গে রাখতে চাইছে জেনে আমি একজনকে দিয়ে সরোজদাকে জানালাম, আমিও বুদ্ধদার সঙ্গেই থাকতে চাই। যেদিন উনি মন্ত্রী থাকবেন না, সরকারি গাড়ি ছেড়ে দেবেন, সেদিন আমিও সরকারি চাকরি ছেড়ে পার্টির কাজে চলে আসব।
কিছু একটা কারণে ১৯৯৩-এ উনি পদত্যাগ করেন। পরদিন আমিও সরকারি গাড়ি গ্যারাজে জমা করে দিয়ে অফিসে পদত্যাগপত্র জমা করে বাড়ি চলে আসি। দলকে জানালাম, বুদ্ধদার জন্য পার্টি যে গাড়ি দেবে সেটা চালাতে চাই। অবশ্য অনেকের চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ফিরতে হয়েছিল। তারপর চার বছর আগে পর্যন্ত প্রতিদিনই বুদ্ধদার সঙ্গে দেখা হত। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ গাড়ি আমিই চালিয়েছি অবসরের দিন পর্যন্ত।
বুদ্ধদাকে কাছ থেকে দেখেছি বলেই জানি, মানুষটার মধ্যে দেখনদারি বলে কিছু ছিল না। মানুষের পাশে দাঁড়াতেন নীরবে। কেউ তা জানুক, তা চাইতেন না। ১৯৯৬-এর কথা। কালাজ্বর নিয়ে আমি নার্সিংহোমে ভর্তি। বুদ্ধদা প্রতিদিন দু-বেলা আমাকে দেখতে যেতেন এবং ডাক্তারদের কাছে আমার চিকিৎসার খোঁজখবর নিতেন।
(সাক্ষাৎকার: অমল সরকার। কয়েক বছর আগে অনুলিখিত। ওসমান এখন গুরুতর অসুস্থ।)