চৈতালী চক্রবর্তী
একুশ শতকের নিষ্ঠুরতম শাসক কি তিনিই? প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ভাব নেই তাঁর, কূটনৈতিক আদান-প্রদান বলতে তীব্র বাক্যবাণ আর ভয়ঙ্কর চোখরাঙানি। অসদ্ভাবের কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে দিন দিন অসহযোগিতাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড সামরিক আস্ফালন, কোনও নিষেধাজ্ঞাই না মেনে বিপজ্জনক ভঙ্গিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োগ। বাধা আসলেই তীর্ব অসন্তোষ, বাহুবলের অবান্তর প্রদর্শনী।
তিনি তিন বছরে দক্ষ ড্রাইভার হয়েছিলেন। ন’বছরে জিতেছিলেন নৌকা প্রতিযোগিতা। বংশানুক্রমিক ধারায় দাদু কিম ইল সুং এবং বাবা কিম জং ইলের মৃত্যুর পরে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ শাসক তিনি। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটির সর্বোচ্চ পদ এবং শাসক দল ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ আসনে চেপে বসা বছর পঁয়ত্রিশের কিম জঙ উনের শাসনকালের প্রায় অধিকাংশই রহস্যে মোড়া। কখনও তাঁকে হাসি মুখে পর্বত শৃঙ্গে চাপতে দেখা গেছে, আবার কখনও সামান্য সন্দেহেই নিকটআত্মীয় থেকে সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তাদের নির্বিচারে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। উত্তর কোরিয়ার অন্দরমহলে ফি দিন কী ঘটনা ঘটছে সেটা একমাত্র চির প্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ মাধ্যমের হাত ধরেই গোটা বিশ্বের সামনে আসে। সেখান থেকেই খবর ছড়ায় দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলিতে।
[caption id="attachment_109840" align="aligncenter" width="618"]

মিটিং চলার সময় নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন শিক্ষা দফতরের এই আধিকারিক। শাস্তি স্বরূপ তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।[/caption]
কিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভূরি ভূরি। ২০১৩ সাল থেকে ’১৬ সালের মধ্যে অন্তত সাত জন ঘনিষ্ঠকে কোতল করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। নিজের সম্পর্কিত মামাকে হিংস্র কুকুরের সামনে ফেলে দিতে পিছপা হননি তিনি। দেশের কোনও সরকারি আধিকারিক মিটিং চলাকালীন ঘুমিয়ে পড়লেও ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে পড়তে হয়েছে তাঁকে। মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে রহস্যজনক ভাবে মারা যান কিমের সৎ ভাই কিম জং-নাম। বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হ্যানয় বৈঠক সফল না হওয়ার কারণে ফের কিম প্রশাসনের ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখে পড়তে হয়েছে সে দেশের পাঁচ শীর্ষ কূটনীতিককে। খবর সামনে এনেছে দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদপত্র চেসান ইলবো।
[caption id="attachment_109837" align="aligncenter" width="640"]
মামা জঙ সঙ-থায়েকের সঙ্গে কিম। উত্তর কোরিয়া প্রতিরক্ষা দফতরের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন জঙ।[/caption]
হত্যালীলার সব খবরই যে সামনে এসেছে এমনটা নয়। কিমের খামখেয়ালিপনার অধিকাংশই সযত্নে চাপা দিয়েছে পিয়ংইয়ং। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর। রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান কিমের এক সম্পর্কিত মামা জঙ সঙ-থায়েক। উত্তর কোরিয়া প্রতিরক্ষা দফতরের ভাইস চেয়ারম্যানের পদে ছিলেন তিনি। ডিসেম্বরের প্রথমেই খবর রটে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে জঙকে। পরে দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ সংস্থা ইয়নহাপ জানায়, সম্ভবত কিমের ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখে দাঁড় করিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। অপরাধ, কিমের সন্দেহে বিশ্বাসঘাতকতা। শুধু জঙ নয়, একের পর এক নির্মম ভাবে, নির্বিচারে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় জঙের গোটা পরিবারকে। তার মধ্যে ছিলেন মহিলা ও শিশুও। খবর এমনও রটে যে মামার মৃতদেহ কুকুরকে দিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলেন কিম।
ওই বছরই ডিসেম্বরে বোন জাং কাই-সান ও তাঁর স্বামী কিউবার রাষ্ট্রদূত জঙ ইয়ং-জিনকে একই ভাবে হত্যার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত কিমের ভাইপো জাঙ ইয়ং-চোলকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ফায়ারিং স্কোয়াডারে মুখে দাঁড় করিয়ে দেন কিম। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়াও ২০১৩ সালে কিম প্রশাসনের একাধিক কর্তাকে হত্যা করার অভিযোগ ওঠে। যার মধ্যে ছিলেন, ওয়ার্কার্স কমিটির প্রথম ডেপুটি ডিরেক্টর রি রিয়ং-হা, কমিটিরই বোর্ড অব মেম্বারের সদস্য জাঙ সু-গিল। বাকিদের নাম অজানা।
সাল ২০১৪। দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদপত্র চেসাল ইলবো-র একটি খবরে হই চই পড়ে যায় গোটা বিশ্বে। সংবাদপত্র দাবি করে, দেশদ্রোহিতার অভিযোগ তুলে উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ডেপুটি সিকিউরিটি মিনিস্টার ও সাঙ-হোনকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছে কিম প্রশাসন। জীবন্ত ও সাঙকে নাকি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ফ্লেমথ্রোয়ার’-এর সামনে। তারপর একটু একটু করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর গোটা শরীর।
[caption id="attachment_109831" align="aligncenter" width="601"]
উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল হিয়ন ইয়োং চোল[/caption]
২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল। সেনা বাহিনীর অনুষ্ঠান। আমন্ত্রিত বহু সরকারি আধিকারিকের সঙ্গে সেখানে হাজির খোদ দেশের নেতা কিম জং উন। কিন্তু সে সব দিকে খেয়াল ছিল না উত্তর কোরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল হিয়ন ইয়োং চোলের। অনুষ্ঠান চলাকালীন চোখটা হয়তো একটু বুজেই এসেছিল তাঁর। কুচকাওয়াজের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধে তাঁকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন কিম। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেস (এনআইএস) জানায়, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে বিমান-বিধ্বংসী কামানের গুলিতে মারা হয়েছে চোলকে। পিয়ংইয়ং থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে কানগন সেনা প্রশিক্ষণ শিবিরে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে যখন চোলকে দাঁড় করানো হয়েছিল, শ’খানেক সরকারি কর্তা তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
অপরাধ কি ছিল শুধু ঘুমিয়ে পড়ারই? দক্ষিণ কোরিয়ার দাবি ছিল, সে দিনের অনুষ্ঠানে কিমের উপস্থিতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন চোল। যা কিমের নজরে দেশদ্রোহিতারই সামিল। এর পরই চোলকে বন্দি করে জেলে আটকে রাখা হয়। পরে ফেলে দেওয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে।
ওই বছরেই নির্মাণসংস্থার দায়িত্বে থাকা ডেপুটি পদমর্যাদার এক আধিকারিক চো ইয়ং-গনকে একই ভাবে হত্যা করে কিম প্রশাসন। তবে তাঁকে কী পদ্ধতিতে কোতল করা হয়েছিল সেই বিষয়টা অজানা।
[caption id="attachment_109835" align="aligncenter" width="624"]
কোরিয়ান পিপল’স আর্মির প্রধান জেনারেল রি ইয়ং-গিল[/caption]
২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়নহাপ নিউজ জানায়, কোরিয়ান পিপল’স আর্মির প্রধান জেনারেল রি ইয়ং-গিলকে কোনও সরকারি অনুষ্ঠানেই আর দেখা যাচ্ছে না। কিমের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিতি ছিল জেনারেল গিলের। ইয়নহাপ দাবি করে, পৃথক রাজনৈতিক গোষ্ঠী তৈরি এবং দুর্নীতির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেওয়া হয়েছে রি ইয়ং-গিলকে। দক্ষিণ কোরিয়া আরও দাবি করেছিল, নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন কিম। দেশের সেনার উপর তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রয়েছে কি না, তা নিয়ে কিম নাকি সন্দিহান। তাই কাউকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলেই, তাঁকে হত্যার আদেশ দিয়ে দিচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা।
হালে দেশের অন্যতম ‘ক্ষমতাশালী’ ব্যক্তি হোয়াং পিয়ং সো রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ। উত্তর কোরিয়ার শাসক কোনও সরকারি অনুষ্ঠানে গেলে তাঁর পাশে সব সময় দেখা যেত হোয়াংকে। দেশের রাজনৈতিক ছবি থেকে তাঁর আচমকা উধাও যাওয়া নিয়ে জল্পনাও কিছু কম হয়নি। উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য ছিলেন হোয়াং। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লোক ছাড়া এই কমিটিতে কাউকে স্থান দিতেন না কিম। তাঁর পরে দেশের সর্বোচ্চ সামরিক ক্ষমতাও ছিল হোয়াংয়ের হাতে। তিনিই ছিলেন উত্তর কোরিয়ার সেনা বাহিনীর ভাইস মার্শাল। এ হেন হোয়াংয়ের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন কিম। দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনেও নাকি খামতি ছিল তাঁর। দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদসংস্থা জানিয়েছে, এই সব অভিযোগের কারণেই সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে হোয়াংকে।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাংবাদমাধ্যম দাবি করে, উত্তর কোরিয়ার উচ্চপদস্থ প্রায় ৭০ জন কর্মচারীর প্রাণ নিয়েছেন কিম। সংখ্যাটা বেশি বই কম নয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ ভাবে ক্ষমতায় নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব বজায় রাখছেন কিম। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ইয়নহাপ মিলিটারি অ্যাকাডেমির একটি ছবি একবার সামনে এনেছিল একটি মানবাধিকার সংগঠন। ছবিটিতে অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফ্ট বন্দুকের সামনে বেশ কয়েক জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল বলে দাবি করেছিল সেই সংগঠন। তাদের তরফে বলা হয়েছিল, উচ্চপদস্থ কর্তাদের শাস্তির জন্যই এই অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফ্ট বন্দুকের ব্যবস্থা রেখেছে কিম প্রশাসন।
[caption id="attachment_109829" align="aligncenter" width="661"]

কোতল করা হয়েছে হ্যানয় সামিটের এই তিন কর্তাকে[/caption]
এক গুচ্ছ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে। পরমাণু এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বেপরোয়া ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর কিম জং-উন প্রবল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে। চেসান ইলবো জানিয়েছে, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের অ্যাজেন্ডা নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে হ্যানয় সামিট ভেস্তে যাওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে দৌত্যের জন্য নিযুক্ত কিম হোক চোল-কে ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখে দাঁড়ি করিয়ে দেন কিম। নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় বিদেশমন্ত্রকের আর চার কর্তাকে।
সত্যিই কি ভালো আছে উত্তর কোরিয়া? পৃথিবীর গণতন্ত্রকামী মানুষজনের একটাই প্রশ্ন, এই স্বৈরাচারী মনোভাব আর কতদিন?
আরও পড়ুন:
https://www.four.suk.1wp.in/international-news-north-korea-executed-5-officials-after-failed-trump-kim-summit/