শেষ আপডেট: 20th July 2023 06:59
দ্য ওয়াল ব্যুরো: চাঁদে (International Moon Day 2023) পাকাপাকিভাবে থাকার বন্দোবস্ত করা যাবে কিনা সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে কিছুদিন গিয়ে থাকলে মন্দ হয় না। মহাকাশচারীরা সেই পৃথিবী থেকে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসে দু’দণ্ড বিশ্রাম নিতে পারেন। আবার অন্য সুবিধাও আছে। চাঁদের মাটিতে কাঠামো তৈরি মানেই জ্বালানির একটা ব্যবস্থা করা যাবে। খাবারদাবারেরও হিল্লে হবে। সুদূর পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে খাবার আর জ্বালানি নিয়ে মহাকাশে ঘুরতে হবে না নভশ্চরদের। মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক তৈরি হবে।
চাঁদে (International Moon Day 2023) আস্তানা তৈরির স্বপ্নটা এখনও গবেষণার স্তরেই আছে। এই স্বপ্নকে বাস্তবের চেহারা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো (ISRO) এবং মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ইসরো মাথা ঘামাতে শুরু করেছে অনেক বছর আগেই। সম্প্রতি এই গবেষণায় ইসরোর হাত ধরেছে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি)। ইসরো ও আইআইএসসির যৌথ গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ‘সেরামিক্স ইন্টারন্যাশনাল’ (Ceramics International) ও ‘প্লস ওয়ান’ (PLOS One) সায়েন্স জার্নালে।
চাঁদের পিঠের (লুনার সারফেস) এক থেকে দুই মিটার নীচে বাঙ্কার বানানোর পরিকল্পনা করছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ, পৃথিবীর পিঠে (যাকে বলা হয়, ভূপৃষ্ঠ) থাকা সম্ভব হলেও, অল্প সময়ের জন্যেও থাকা সম্ভব নয় চাঁদে। কারণ চাঁদে কোনও বায়ুমণ্ডল নেই।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের অনেক রকমের ঝড়, ঝাপটার হাত থেকে বাঁচায়। সূর্যের করোনা বা বায়ুমণ্ডল থেকে ধেয়ে আসে সৌরবায়ু, সৌরঝড়, করোনাল মাস ইজেকশানের মতো ভয়ঙ্কর সব শত্রুরা। বায়ুমণ্ডল না থাকলে যাদের দাপটে মানুষের টিকে থাকা কোনওভাবেই সম্ভব হত না।
আরও পড়ুন: ধাপে ধাপে চাঁদে, রুক্ষ মাটিতে উড়ল বিজয় পতাকা, ফিরে দেখা ৫৪ বছর আগের সেই দিন
আমাদের সৌরমণ্ডল হয় তাদের শুষে নেয় বা বদলে দেয় অন্য কোনও কণা বা মৌলে অথবা তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয় মহাকাশের অন্য কোনও দিকে। ওই শত্রুদের হাত থেকে বাঁচায় পৃথিবীর অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের একটি পুরু আবরণীও। সূর্য থেকে ধেয়ে আসা খুব শক্তিশালী মারণ কণাদের অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। চাঁদে বায়ুমণ্ডল বা চৌম্বক ক্ষেত্র কিছুই নেই। তাই চাঁদে থাকতে হলে বাঙ্কার বানাতে হবে মাটির নীচে। যার উপরটা এমন কোনও পদার্থ দিয়ে বানাতে হবে যাতে তা সেই সব শক্তিশালী সৌররশ্মি বা মহাজাগতিক রশ্মিদের পুরোপুরি শুষে নিতে পারে। তাতে বাঙ্কারের উপরটা গরম হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু তার তাপমাত্রা কমিয়ে আনার অন্য উপায়ও আছে।
চাঁদে আমাদের থাকার জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা হিসাবে এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের পছন্দ আমাদের একমাত্র উপগ্রহের দক্ষিণ মেরু ও তার লাগোয়া এলাকা। চাঁদের আঁধার পিঠে বরফ জমে থাকার সম্ভাবনাও আছে। তাই যদি সেই বরফের হদিশ একবার মেলে তাহলে জলের চাহিদাও মিটবে। সেই কারণেই চাঁদের দক্ষিণ মেরুর হাল হকিকত বোঝার এত চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। ইসরোর দ্বিতীয় চন্দ্রযানকেও সেই কারণেই পাঠানো হয়েছিল, তবে সেই মিশন পুরোপুরি সফল হয়নি। চন্দ্রযান-৩ চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকেই যাচ্ছে। এই অভিযান সফল হলে চাঁদে আস্তানা বানানোর পরিকল্পনায় হয়ত আরও একধাপ এগনো যাবে।
আইআইএসসির গবেষকরা জানিয়েছেন, বাঙ্কারের মতো একটা কাঠামো আগে তৈরি হবে। তার জন্য চাঁদের (International Moon Day 2023) মাটি (Lunar Soil) ও ব্যাকটেরিয়াদের নিয়ে গবেষণা চালানো হচ্ছে। চাঁদের মাটি পৃথিবীর মতো নয়। তার ওপর চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই। তাই মাটির উপরে বাঙ্কার বানানো অতটা সহজ নয়। সেক্ষেত্রে লুনার সারফেস (Lunar Surface) বা চাঁদের পৃষ্ঠদেশ থেকে কিছুটা নীচে বাঙ্কার বানানো যেতে পারে।
এই বাঙ্কারের ভিত তৈরি হবে যে ইট দিয়ে সেটা বানানো হবে ইউরিয়া থেকে। সিমেন্ট নয় ইউরিয়া ও গুয়ার গামের সাহায্যে স্পেস ব্রিক (Space Brick) তৈরি হবে। গুয়ার গামকে বলা হয় গুয়ারান, একধরনের পলিস্যাকারাইড যা গুয়ার বীজ থেকে তৈরি হয়। শিল্পকারখানায় এই ধরনের গাম ব্যবহার করা হয়।
স্পেস ব্রিকেই শুধু কাজ চলবে না। এমন কিছু ব্যাকটেরিয়াকে বেছে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা, যেগুলি তাদের বিপাকক্রিয়ার মাধ্যমে খনিজ উপাদান তৈরি করবে। এই খনিজ কাঠামো তৈরির কাজে লাগবে। এমনই একটি ব্যাকটেরিয়া হল ‘স্পোরোসারসিনা পাস্তুরি’ ।
এই ব্যাকটেরিয়া ক্যালসিয়াম কার্বোনেট তৈরি করবে। ইউরিয়া ও ক্যালসিয়ামের সাহায্যে ইউরিওলাইটিক সাইকেলে তারা ক্রিস্টাল তৈরি করবে যেগুলি কাঠামোর ভিত তৈরির কাজে লাগাবেন বিজ্ঞানীরা। ইসরোর বিজ্ঞানী অর্জুন দে ও আই ভেনুগোপাল বলেছেন, তাঁরা প্রথমে ব্যাকটেরিয়াদের চাঁদের মাটিতে মিশিয়ে দেবেন। সেখানে তাদের খাবার জন্য পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম ও ইউরিয়া দেওয়া হবে। চাঁদের মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হবে গুয়ার গাম। ব্যাকটেরিয়ারা তাদের খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট তৈরি করবে। এই খনিজের শক্তি বাড়িয়ে শক্তপোক্ত ক্রিস্টালের মতো চেহারা দেবে গুয়ার গাম। কয়েকদিনের ইনকিউবেশনে এমন উপাদান তৈরি হবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সিমেন্টের থেকে অনেক বেশি কার্যকরী হবে এই উপাদান। চাঁদের পিঠে মজবুত কাঠামো তৈরি করা যাবে।
মহাকাশে পৃথিবীর কক্ষে স্পেস স্টেশন বানানোর পরিকল্পনাও আছে ইসরোর। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের (ISS) মতো নিজস্ব স্পেস স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা ইসরোর বহুদিনের। সে জন্য গগনযান মিশনের পরিকল্পনা। গগনযানে চেপে নভশ্চররা মহাকাশে গিয়ে পৃথিবীর কক্ষের খবরাখবর নিয়ে আসবেন। মহাকাশে একটা পাকাপাকি হিল্লে হলে চাঁদে পাড়ি বা মঙ্গল-মিশন অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে বলে মনে করছে ইসরো। এতদিন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের মায়া কাটাতে নানা রকম রকেটের পিঠে চাপিয়ে মহাকাশযানগুলির উৎক্ষেপণ করতে হত। সেটা আর করতে হবে না। স্পেস স্টেশন হবে পৃথিবীর বাইরেই, অতএব অর্ধেক কাজ হয়েই গেল।
স্পেস স্টেশনে বসেই নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষা করা সহজ হবে। মাইক্রোগ্র্যাভিটির গবেষণা অনেক সহজ হবে। নাসার মতোই মহাকাশের বিভিন্ন সময়ের ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠাতে পারবেন মহাকাশচারীরা। মহাকাশবিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।