শেষ আপডেট: 10th May 2023 14:38
দ্য ওয়াল ব্যুরো: তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তর্কাতীতভাবে, পাকিস্তানি ক্রীড়াদুনিয়ায় তিনি বিশ্ববরেণ্য নায়ক। ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তাঁর অধিনায়কত্বে সেই তোলপাড় ফেলা বিশ্বকাপ জয় পাকিস্তানের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় সাফল্য। তাঁর উপস্থিতিটাই একটা অন্য মাত্রা যোগ করে। ইমরান খান (Imran Khan)। আজও, পাক জনমানসে তিনি 'কাপ্তান সাহেব'। মঙ্গলবার তাঁর আচমকা গ্রেফতারির খবরে কার্যত উত্তাল পাকিস্তান (Pakistan)। ইসলামাবাদ জুড়ে জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা।
তাঁর জীবনটাই এক রোমাঞ্চকর গল্প। লাহোরের এক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের সন্তান। স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটেছে ছোটবেলা। পড়াশোনা করেছেন লাহোরের শতাব্দীপ্রাচীন অ্যাচিসন কলেজে। তারপর সটান পাড়ি দেন বিলেতে। ভর্তি হন অক্সফোর্ডে (Oxford)। শোনা যায়, শুরুতে অক্সফোর্ডের দরজা খোলেনি। পরে কিছু প্রভাবশালীর হস্তক্ষেপে সিকে ছেঁড়ে। ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ডের কিবল কলেজ থেকে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হ'ন।
অক্সফোর্ডে (University of Oxford) পড়তে পড়তেই ক্রিকেটার ইমরান খান চলে আসেন প্রচারের আলোয়। অক্সফোর্ডের ক্রিকেট দলে খেলেছেন নিয়মিত। তারপর যোগ দেন সাসেক্সে। তখন থেকেই মাঠের বাইরেও তাঁর পারফরম্যান্স ব্রিটিশ মিডিয়ার নজর কাড়ে। লন্ডনের অভিজাত মহল্লায় একের পর এক নারীসঙ্গের মাদকতায় বিভোর হতে থাকেন, শুরু করেন উদ্দাম প্লেবয় (Playboy) জীবন! শোনা যায়, প্রায় একইসময় অক্সফোর্ডে পড়তেন বেনজির ভুট্টো। তাঁর সঙ্গেও সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ইমরানের এক জীবনীকার। যদিও ইমরান বলেছেন, তাঁরা কেবলই ভাল বন্ধু। নাম জড়িয়েছিল জিনাত আমন, রেখার সঙ্গেও।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ইমরানের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক আজকের নয়। ইমরান যখন বিশ্বকাপ জেতেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। ঠিক তাঁর আগের অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক ছিল ভারত ও পাকিস্তান। সেমিফাইনালে পাকিস্তান খেলেছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে, আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ছিল ভারত।
সারা পৃথিবী অপেক্ষা করে ছিল সেই মহাজাগতিক বিশ্বকাপ ফাইনালের, ভারত বনাম পাকিস্তান! ফাইনাল হয়েছিল কলকাতায়। স্রেফ এই আন্দাজেই উল্কার বেগে উড়ে গিয়েছিল সব টিকিট। কিন্তু লাহোরে ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তান। আর মুম্বইতে ভারতকে হারায় মাইক গ্যাটিং-এর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান। ইডেনে ফাইনালে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড!
ইমরান সেবারেই অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন। শোনা যায়, এরপর তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন খোদ পাকিস্তানের ফৌজি রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া উল হক। ইমরান রাজি হন পরের বিশ্বকাপের জন্য। পরের ঘটনা ইতিহাস।
বিশ্বকাপ জিতেই শেষ অবধি অবসর নেন ইমরান। শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক জীবন। ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর নিজের দল— পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফ বা পিটিআই (Pakistan Tehreek i Insaf)। অথচ তাঁর মত চূড়ান্ত জনপ্রিয় বন্দিত নায়কের পক্ষেও রাজনীতিতে বিশেষ কল্কে পাওয়া সম্ভব হয়নি। পিটিআই সেরকম জনপ্রিয়তার ধারপাশ দিয়েও যায়নি শুরুতে। পাকিস্তানের রক্ষণশীল সমাজ, উন্নত আধুনিক শিক্ষার আলোর বাইরে থাকা গ্রামীণ জনতার একাংশ ইমরানের মত অতি-আধুনিক, বিলিতি আদবকায়দায় অভ্যস্ত, রঙিন জীবন যাপন করা কাউকে নেতা হিসেবে ভাবতেই পারেনি।
ইমরান অতএব অন্য পথ ধরলেন। লন্ডনের সেই নিয়ন্ত্রণহীন যুবক হঠাৎই হয়ে উঠতে চাইলেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। জনতার জন্য বিগলিতপ্রাণ।
১৯৯৯ সালে নওয়াজ শরিফকে হঠিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেন সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মুশারফ। তারপরের আট বছর মোটের ওপর পাকিস্তানে স্থিতাবস্থা ছিল। বলা হয়, মুশারফ জমানাতেই পাকিস্তানের লোকসভা 'ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি' বা জাতীয় পরিষদ প্রথম তার পুরো পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে। তার আগে একবারের জন্যও সভা মেয়াদ শেষ করতে পারেনি, কোনও না কোনওভাবে ঠিক সরকার পড়ে গিয়েছে। ২০০৮ সালে শেষ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা করে পাক নির্বাচন কমিশন।
তখন পাকিস্তানে ক্ষমতার শীর্ষে উত্থান চলছে 'পাকিস্তান পিপলস পার্টি' বা পিপিপি-র। দেশে ফিরে এসেছেন বেনজির ভুট্টো। ২০০৭-এর অক্টোবরে করাচিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে, এবার নিশ্চিতভাবেই প্রধানমন্ত্রীর পদে বসতে চলেছেন তিনি। নওয়াজ শরিফ তখনও সৌদি আরবে। অথচ মাত্র দু’মাসের মধ্যে ঘটে গেল নক্ষত্রপতন। ২৭ ডিসেম্বর সকালে হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বেনজির। সেদিন বিকেলেই বুলেটপ্রুফ গাড়ির বাইরে বেরোতেই রাওয়ালপিণ্ডি কেঁপে উঠল বিস্ফোরণে। উপমহাদেশে তোলপাড় ফেলে খুন হয়ে গেলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো।
সেবারের নির্বাচন জিতেছিল পিপিপি। কিন্তু আসিফ আলি জারদারির পক্ষেও মেয়াদ পুরো করা সম্ভব হয়নি। ২০১০ থেকে আবার ইমরানের কপাল খুলতে শুরু করে। চূড়ান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে পিপিপি প্রধান জারদারির বিরুদ্ধে। পাশাপাশি, পাকিস্তানে দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা। কার্যত নতুন করে অক্সিজেন জোটে ইমরানের।
২০১৩ সাধারণ নির্বাচনে শেষ অবধি ৩৫টি আসনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় পাকিস্তানকে। ১৬৬টি আসন জিতে এবং কিছু নির্দলের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠাতায় সরকার গঠন করে নওয়াজ শরিফ। ততদিনে পাকিস্তানের উত্তরে রুক্ষ, শুকনো, হিন্দুকুশ-সুলেইমানের পাহাড়ি প্রান্তরে ছড়ানো খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে প্রাদেশিক সরকার গড়েছেন ইমরান। এদিকে সমর্থন চাঙ্গা করতে তখন থেকেই রক্ষণশীল পাক তালিবানদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। লন্ডনের অভিজাত, উদারপন্থী জীবনে অভ্যস্ত ইমরান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ক্ষমতায় থাকতে পাকিস্তানের শক্তিশালী মোল্লাতন্ত্রকে তুষ্ট করার নীতি নিয়ে চলছেন তিনি।
নওয়াজ শরিফের রাজত্বও স্থায়ী হয়নি। ক্ষমতায় তাঁর পরেই নয়াদিল্লির লোক কল্যাণ মার্গে প্রবেশ করেছিলেন নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদী। তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে কূটনীতির মোক্ষম চালে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রীকে। নওয়াজ এসেছিলেন দিল্লিতে, শুভেচ্ছা বিনিময় করে গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালে পানাম পেপার কেলেঙ্কারিতেই নওয়াজের ঘটি উল্টে যায়। আদালতের রায়ে তাঁকে নির্বাসিত করা হয়, কারাদণ্ডের আদেশও দেওয়া হয়। ২০১৮নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে ইমরানের পিটিআই দল।
অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান। শুরু করেছিলেন তাঁর 'প্রথম একশো দিনের লক্ষ্যমাত্রা'। নজরে ছিল চাষিদের ভর্তুকি দেওয়া, ক্ষুদ্র শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো, উৎপাদনে বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ, পাকিস্তানি রুপির বিনিময় মূল্য কমানো। বিশেষ করে আর্থিক সংস্কারে ইমরান কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন দেশের কর ব্যবস্থার সংস্কার করে অভিজাতদের প্রদেয় করের হার বাড়াতে। দক্ষিণ পাঞ্জাবে সরাইকিস্তান বলে মুলতানিভাষি সরাইকি জাতির জন্য আলাদা প্রদেশের ভাবনাও ছিল তাঁর। লাহোরের ছেলে ইমরান করাচিকে ঢেলে সাজাতেও পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি কিছুই কাজে আসেনি। তাঁর শত্রুর সংখ্যা বাড়তেই থাকে। তাঁর বিরুদ্ধেও ওঠে বেনিয়মের অভিযোগ। মোল্লাতন্ত্র, আইএসআই, সেনা সবাইকেই নানাভাবে চটিয়ে ফেলেন তিনি। ২০২২ সালে আস্থাভোটে হেরে বিদায় নিতে হয় তাঁকে।
পাকিস্তানে সেনাকে চটিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব। কিন্তু এসবকে ছাপিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে যে প্রশ্ন, তা হল, ইমরান ঠিক কোন পথে রাজনীতি করতে চান? সেটাই এখনও নানাভাবে ধোয়াঁটে। ইতিমধ্যেই তাঁর ওপরেও হত্যার চেষ্টা হয়েছে। তাঁর সমর্থকরা পদযাত্রা করেছেন। কিন্তু তাতে ভোটের অঙ্কে সাফল্য আসবে কিনা, সেটা নিয়েই ধন্দে বিশেষজ্ঞরা।
আপাতত দুর্নীতির অভিযোগেই আবার বিদ্ধ তিনি। অভিযোগ, একটি নির্মাণকারী সংস্থার থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন ইমরান। সেই 'আল-কাদির' মামলাতেই আদালতে তাঁকে গ্রেফতার করল পুলিশ। এক ট্যুইট বার্তায় ইসলামাবাদ পুলিশের আইজি আকবর নাসির খান জানিয়েছেন, ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে ইসলামাবাদে। যদিও বাড়াবাড়ি হিংসার ঘটনা ঘটেনি। ইমরানের বাড়ি ঘিরেও কড়া পুলিশি নিরাপত্তা রয়েছে। কিন্তু পুলিশের ট্যুইটেই তারপর জানানো হচ্ছে, শহর জুড়ে তীব্র হচ্ছে বিক্ষোভ। ইসলামাবাদে যানজট ক্রমশই বাড়ছে। বন্ধ করে দিতে হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে।
ইমরান খানের জন্য গল্পও যেন বাস্তবের চাইতে বেশি রোমাঞ্চকর।
ইমরান খান গ্রেফতার, হাইকোর্টের বাইরে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে ধরল পাক সেনা