শ্যামনগর
শেষ আপডেট: 13th March 2025 11:54
দ্য ওয়াল ব্যুরো: পঞ্চদশ শতকের কবি বিপ্রদাস পিপলাই। ‘মনসার ভাসান’ কাব্যে তিনি লিখেছিলেন: ‘‘মূলাজোড়া গাড়ুলিয়া বাহিল সত্বর/ পশ্চিমে পাইকপাড়া বাহে ভদ্রেশ্বর/ চাঁপদানি ডাইনে বামেতে ইছাপুর/ বাহ বাহ বলি রাজা ডাকিছে প্রচুর।’’
এই মূলাজোড়া বা মূলাজোড়, পুরাতাত্ত্বিক ও গবেষকদের মতে, শ্যামনগরের পূর্বনাম। সেই সময় শহরের এক প্রান্তে ছিল ব্রহ্মময়ী কালীমন্দির, অন্য দিকে জয়চণ্ডীদেবীর দেউল। শ্বাপদে, জলে, জঙ্গলে আর দস্যুদের আকছার আনাগোনায় মূলাজোড় তখন অন্য এক অঞ্চল। সাহিত্যের ইতিহাসে যা জায়গা করে নিয়েছে অন্য এক কারণেও। কথিত আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দরবারি কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরকে এই গ্রামটি উপহার দিয়েছিলেন। কালক্রমে মূলাজোড় বদলে যায় শ্যামনগরে। এই নামবদল যতটা না ভাষাতাত্ত্বিক, তার চেয়েও বেশি প্রত্নতত্ত্ব-সংশ্লিষ্ট।
কিন্তু স্থাননাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি একমেটে নয় কখনওই। একটিমাত্র মতের বিরুদ্ধে উঠে আসে একাধিক তত্ত্ব-সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় পক্ষের দাবি, শ্যামা মায়ের নামের অনুষঙ্গে জায়গার নাম শ্যামনগর।
এই যুক্তি সুবোধ্য হলেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়৷ কারণ পালটা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে উঠে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা শ্যামনগরের উৎপত্তির পেছনে বর্ধমান রাজবংশের ইতিহাস খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের যুক্তি: কোনও এক সময়কালে রাজপুরোহিত ছিলেন রামেশ্বর চক্রবর্তী। গৃহদেবতা হিসেবে তিনি প্রতিদিন শ্যামকিশোরের আরাধনা করতেন। সেই সূত্রেই নাকি শ্যামনগর নামের জন্ম!
আজও এই তত্ত্ব আঁকড়ে রয়েছেন সৌরভ অধিকারী। রামেশ্বরের দশম পুরুষ। সৌরভ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের বাড়িতে দুই বিগ্রহের অর্চনা হয়ে আসছে। এটাই রেওয়াজ। একটি গোপালকিশোরজি, বড়ভাই। অন্যটি শ্যামকিশোর, ছোটভাই। আর এই শ্যামকিশোরের সূত্রেই শ্যামনগর নামকরণ। কিন্তু এই ইতিহাস আজ কালের গর্ভে তলিয়ে গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠবে: বর্ধমানর রাজপুরোহিতের দেববিগ্রহের নামের সূত্রে অধুনা ব্যারাকপুর শিল্পনগরীর অন্যতম শহরের নাম এল কী করে? নিছক ভূগোল ঘাঁটলেও তো দূরত্ব অনেকটাই! আর এই সওয়ালের জবাবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে চাপা-পড়া-অতীত ও ইতিহাসের গল্প।
লোকশ্রুতি এই যে, একসময় বর্ধমান রাজার মহলেই পূজিত হতেন গোপালকিশোরজি ও শ্যামকিশোরজি। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় (১৭৪১-১৭৫১) একাধিকবার বর্গিরা বাংলাজুড়ে আক্রমণ চালায়। বর্ধমানও তার আঁচ থেকে রেহাই পায়নি। বর্গিদের অত্যাচার চরমে পৌঁছলে হামলা থেকে বাঁচতে বর্ধমানরাজ রাজ্য ছেড়ে মূলাজোড় ও তার আশপাশের অঞ্চলে আত্মগোপন করে থাকেন।
হিসেব অনুযায়ী, সেই আমলে নোয়াপাড়া পর্যন্ত তাঁর আধিপত্য ছিল। এখানে একসময় বর্ধমানরাজের প্রাসাদও নির্মিত হয়। তাই বর্গিহানা থেকে প্রাণ বাঁচাতে দেশছাড়া রাজা এখানেই গোপালকিশোরজি ও শ্যামকিশোরজিকে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। কাউগাছি নামে একটি জায়গায় মন্দির স্থাপন করেন।
ইতিহাস বলছে, ওই নবনির্মিত মন্দিরের পূজারী ছিলেন রামেশ্বর চক্রবর্তী। বর্গিরা লুঠতরাজ সেরে ফের মারাঠাভূমে ফিরে গেলে রাজা চলে আসেন নিজের রাজ্য বর্ধমানে। কিন্তু কাউগাছির মন্দিরে রয়ে যায় দুটি বিগ্রহ। নিছক জনশ্রুতি নয়, এর সত্যতা ইতিহাসবিদ ভূপতিরঞ্জন দাস তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ ও দর্শন’ বইতেও উল্লেখ করেছেন।
এই প্রচারিত শ্রুতি ও ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে একমত সৌরভও। সেই সঙ্গে যোগ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বর্ধমানে ফেরার আগে জমি, মন্দির ও কষ্টিপাথরের দুই কৃষ্ণমূর্তি ও অষ্টধাতুর রাধাবিগ্রহের দেখভালের দায়িত্ব রামেশ্বর চক্রবর্তীকে দিয়ে গেছিলেন বর্ধমানরাজ। কালে কালে জমিদারি প্রথা লোপ পায়। সরকার রাজপরিবারের অনেক জমি অধিগ্রহণ করে নেয়। সেই সময় শ্যামকিশোরজি ও গোপালকিশোরজির মন্দিরও সরকারি লালফিতের ফাঁসে জড়িয়ে পাকচক্রে হারিয়ে যায়।
তবে জমি হারালেও মানুষ রয়ে যায়। থেকে যায় স্মৃতি। মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা চক্রবর্তী পরিবার সেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার স্মৃতিকে জিইয়ে রাখেন। ‘অধিকারী’ পদবি লাভের পর তাঁরা দুটি বিগ্রহ নিজেদের বাস্তুভিটেয় এনে প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকে বহু যুগ ধরে এভাবেই তাঁদের বাড়িতে পূজিত হয়ে আসছেন শ্যামকিশোরজি ও গোপালকিশোরজির যুগলমূর্তি।
ইতিহাসের এই মান্যতা সত্ত্বেও বর্তমান প্রশাসনের আচরণে রীতিমতো বিমর্ষ রামেশ্বরের উত্তরপুরুষ সৌরভ। অবসাদভরা গলায় তিনি জানান, ‘পুরসভা সবটাই জানে, প্রত্নতাত্বিক বিভাগের গবেষকরা আসেন, সব শোনেন আর ফিরে যান। কিন্তু এই ঠাকুরের জন্য কোনও মন্দির প্রতিষ্ঠা করার পদক্ষেপ নেওয়া হয় না।’