শেষ আপডেট: 15th March 2025 21:49
সেদিনটা ছিল ২ জুন, ২০২৪। তার আগের দিন লোকসভা নির্বাচনের শেষ দফার ভোট গ্রহণ হয়েছে। তার পরই তামাম বুথ ফেরত সমীক্ষা ইঙ্গিত করেছিল, বাংলায় বিজেপির (BJP) আসন সংখ্যা বাড়ছে। পর দিন জরুরি ভিত্তিতে দলের রাজ্য ও জেলা সংগঠনের নেতাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন তৃণমূলের (Trinamool Congress) সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। বলাবাহুল্য এমন কোনও বৈঠক ডাকার কথা সংগঠনের আর কারও মাথায় কিন্তু আসেনি। ৪ জুন ভোট গণনার আগে আসন ধরে ধরে ঘুঁটি সাজানো হয়েছিল ওই বৈঠকে। কারণ, আই প্যাক তথা অভিষেকের সমীক্ষা ছিল কোনওমতেই ১৫টির বেশি আসনে জিতবে না গেরুয়া শিবির। এমনকি তৃণমূল এ ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিল যে বিষ্ণুপুর আসনটি বিজেপিকে অতি সামান্য ব্যবধানে হলেও পরাস্ত করতে পারবে।
সেই শেষবার। তার পর সংগঠনের ব্যাপারে দলের নেতাদের আর কোনও বৈঠকে ডাকেননি অভিষেক। ২৮৫ দিনের ব্যবধানে শনিবার তৃণমূলের যে বৈঠকের নেতৃত্ব দিলেন তিনি, তা শুধু আড়ে বহরে বড় নয়, বরং তার পরতে পরতে যেন লেখা ছিল, এই তো আমি। সংগঠনের ব্যাপারটা যেমন দেখছিলাম, তেমনই দেখব। আর কোনও দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই।
চব্বিশ সালের ২ জুন ও পঁচিশ সালের ১৫ মার্চের মধ্যে যেন কোনও ফারাকই নেই। মাঝে বিভ্রান্তির ২৮৫ দিনও লহমায় উধাও। সম্ভবত সেই কারণেই ১৫ মার্চের দিনটাও তৃণমূলে হয়তো মাইলফলক হয়ে থাকবে। ক্যালেন্ডারে লেখা থাকবে, কামব্যাক হল অভিষেকের।
শনিবারের বৈঠকে অভিষেককে বারবার ‘আমাদের সবার নেতা’ বলে সম্মোধন করেছেন রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। অর্থাৎ অভিষেকই যে নেতা তা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন স্বয়ং রাজ্য সভাপতি। তৃণমূলে এই নয়া অক্ষ অবশ্যই পৃথক আলোচনার বিষয়।
শুধু কি তাই, ভুতূড়ে ভোটারের প্রসঙ্গ ও পরিধি অতিক্রম করে অভিষেক এদিন সামগ্রিক ভাবেই ছাব্বিশের লড়াইয়ের এক প্রকার নকশা দেখিয়েছেন এদিনের বৈঠকে। কীভাবে ছাব্বিশের ভোট পর্যন্ত বুথ স্তরে দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হবে সে কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, জেলা ও ব্লক স্তরে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতেই রদবদল হবে।
প্রশ্ন হল, এই কথাটা ঘোষণা করার এক্তিয়ার কার রয়েছে?
কালীঘাটের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতার কথায়, এর একটাই জবাব, যাঁর হাতে সেই ক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ তৃণমূলের সাংগঠনিক বিষয়আশয় যে অভিষেকই দেখবেন তা নিয়ে এই বৈঠকের পর আর কোনও রহস্য থাকার কথা নয়।
এই কথাটা হয়তো নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু গত ২৮৫ দিন ধরে যে ঘটনাক্রম চলেছে তাতেই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল। এবার সেদিকেই একবার নজর বুলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। লোকসভা ভোটে বাংলায় বিজেপির আসন সংখ্যা বাড়া তো দূরস্থান, তা কমে দাঁড়ায় ১২। আর তৃণমূল শক্তি বাড়িয়ে পৌঁছে যায় ২৯-এ। যা বাংলায় শাসক দলকে প্রভূত অক্সিজেন জুগিয়েছিল।
নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বার্তায় তার দিব্য প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছিল। তবে এও দেখা যাচ্ছিল যে, ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই নিজেকে একটু একটু করে গুটিয়ে নিচ্ছেন অভিষেক। তার পর ১২ জুন একটি টুইট করে অভিষেক জানিয়ে দিয়েছিলেন, চিকিৎসার কারণে তিনি সাময়িক ভাবে সংগঠনের কাজ থেকে বিরতি নিচ্ছেন।
শুধু সে টুকু বার্তা দেওয়াই নয়, অভিষেক যেন সেই টুইটে এও বোঝাতে চেয়েছিলেন, লোকসভা ভোটে যেটা করে দেখাতে চেয়েছিলাম, তা করে দেখিয়েছি, এখন চললাম কিছু দিনের জন্য।
এ ঘটনার পর দেখা যায়, পরিস্থিতি এমনই যে ২১ জুলাইয়ের সভায় অভিষেক থাকবেন কি থাকবেন না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। শেষমেশ ২১ জুলাইয়ের তিন আগে তিনি কলকাতায় ফেরেন এবং সভায় বক্তৃতা দেন। সেই সঙ্গে ইঙ্গিত দেন যে তৃণমূলের সংগঠনে ব্যাপক রদবদল ঘটতে চলেছে।
তবে এরই মধ্যে ৮ অগস্ট আরজি করের ঘটনা ঘটে যায়। যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় তিন মাস অস্থিরতা চলে রাজ্যে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সেই পর্বেও অভিষেক নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। এবং দলের মধ্যে ও বাইরে কেউ কেউ রটিয়ে দেন যে অভিষেক পৃথক দল গঠন করতে চলেছেন। মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার বা একনাথ শিন্ডের মতো তিনি হাত মেলাতে পারেন বিজেপির সঙ্গে। তৃণমূলের মধ্যে এও রটে যায় যে, অভিষেকের উপর রুষ্ট মমতা। তাই সংগঠনের রাশ দিদি নিজের হাতেই তুলে নিয়েছেন। তৃণমূলনেত্রীর কথাতেও সেই ধারণা দৃঢ় হয়। তা ছাড়া আই প্যাক সম্পর্কেও তীর্যক মন্তব্য করেন দিদি।
আবার তার পর এও দেখা যায়, দলে প্রবীণ নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ বেশ অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছেন। কাউকে কাউকে হঠাৎ করেই অতিশয় শক্তিশালী বলে আপাত দর্শনে মনে হচ্ছিল। কেউ আবার রাজ্য সভাপতির পদের দিকেও তাকাতে শুরু করেন বলে খবর। কারণ, তাঁরা ধরে নেন যে অভিষেক ও দিদির মধ্যে মতান্তর সহজে মেটার নয়। কোথাও একটা আস্থার ঘাটতি প্রবল হয়েছে।
কিন্তু কোথায় কী! গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তৃণমূলের বর্ধিত কর্মিসভা ডাকা হয়েছিল। তার আগেই বরফ গলতে দেখা যায়। এবং স্পষ্ট হয়ে যায় অভিষেক ও দিদির মধ্যে আগের মতোই তালমিল ও বোঝাপড়া রয়েছে। যে বোঝাপড়ার সূত্রে আপাতত হয়তো তৃণমূলে সবস্তরে রাতারাতি কোনও রদবদল হবে না। তবে আই প্যাক আগের মতোই কাজ করবে। এবং ছাব্বিশের ভোটের আগে আগের মতই সংগঠন দেখবেন অভিষেক। সেই সূত্র ও শর্তের প্রথম ও প্রকট বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল শনিবার।