Date : 21st May, 2025 | Call 1800 452 567 | info@thewall.in
কান উৎসবে হাঁটতে ফ্রান্স পৌঁছলেন ঐশ্বর্যা, সঙ্গে এবারেও আরাধ্যা, মুহূর্তে ভাইরাল ভিডিওকলকাতায় 'মাদারহুড হসপিটালস'-এর ২৫তম হাসপাতাল, পূর্ব ভারতে মাতৃ ও শিশুসেবায় নতুন দিগন্তনতুন জীবন পেল কিশোর, বিরল নিউরো অস্ত্রোপচারে মৃগী সারল কলকাতার হাসপাতালেশাহরুখ তখনও 'কিং' হননি, পুরনো ছবি শেয়ার করে বন্ধু লিখলেন, '৩৫ বছর আগে সেই ট্রেন যাত্রায়...'ক্ষীরপাইয়ে দুই বাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত ৩, আশঙ্কাজনক আরও ১ইনস্টাগ্রামে একে অপরকে ‘আনফলো' যশ-নুসরতের, জল্পনার পারদ চড়ছে টলিপাড়ায়IPL 2025: ফের চলল বৈভবের ব্যাট, বেলাইন চেন্নাই এক্সপ্রেসরবীন্দ্র সরোবরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, ভরদুপুরে গাছ পড়ে মৃত্যু ফুল ব্যবসায়ীরশাহরুখ মধ্যবিত্তই রয়ে গেল, কোনও দামী ব্র্যান্ড ওকে খুশি করতে পারে না: অনুভব সিনহাআত্মবিশ্বাসী শুভাশিস গুরুত্ব দিচ্ছেন সুনীলের অভিজ্ঞতাকে
Higher Studies

বিয়ে ছাড়া গতি নেই, বলেছিল সমাজ, হার্ভার্ড পেরিয়ে আজও উড়ছেন শ্যামনগরের 'ছোট জাতের মেয়ে’

শুরুটা হয়েছিল সমাজের অপমান আর বিয়ের চাপ দিয়ে, হার্ভার্ড, ভেরোনা, ক্যালিফোর্নিয়ার ল্যাব পেরিয়েও শেষ হল না যাত্রা। রীতুপর্না বিশ্বাসের জীবন কাহিনি উদ্দীপনা জাগায় পিছিয়ে থাকা হাজারো মেয়েকে।

বিয়ে ছাড়া গতি নেই, বলেছিল সমাজ, হার্ভার্ড পেরিয়ে আজও উড়ছেন শ্যামনগরের 'ছোট জাতের মেয়ে’

রীতুপর্না বিশ্বাস

শেষ আপডেট: 3 May 2025 07:33

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

মাথাজোড়া ছবি, পাতাজোড়া তালিকা। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরে খবরের কাগজের প্রথম পাতা এমনই দেখতে লাগে। একঝাঁক উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্বলে ওঠে শিক্ষার অঙ্গনে। কয়েকদিন মাতামাতির পরে সেসব নাম হয়তো বা হারিয়ে যায়। কোনও কোনও নাম আবার চিরভাস্বর হয়ে জ্বলে থাকে, বছরের পর বছর ধরে। 

কিন্তু এই আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির উল্টোদিকে যে অন্ধকারের ছেলেমেয়েরা থাকে, তাদের কথা হয়তো এই সময়ে বলা হয় না। তবে এমনও কিছু 'ব্যর্থতা' রয়েছে, যারা ভাঙা পায়ে, কাঁটামোড়া পথে, এক পা এক পা করে ফেলেছেন হারতে হারতেও। শেষমেশ নিজেদের মধ্যে জমানো আলোয় নিজেদের ফুটিয়ে তুলেছেন অন্ধকারের গায়েই। মধ্যরাতের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো জ্বলে উঠেছেন নিজেদের সময়ে এবং নিজেদের শর্তে। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের দিনগুলোতে, তাঁদের আজও মনে পড়ে, নিজেদের সেই ম্লান মুখটা। যে মুখ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সকলে। সক্কলে।

স্বপ্ন দেখার সাহস

এমনই একজন বঙ্গতনয়া, রীতুপর্না। শ্যামনগরের রীতুপর্না বিশ্বাস। একসময় যাঁকে বলা হয়েছিল 'ছোট জাতের মেয়ে', 'নিচু পরিবারের সদস্য', আজ তাঁরই নাম আলোকিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্কলারশিপ থেকে শুরু করে পিএইচডি-র আঙিনায়, পৌঁছে গেছে 'মারি কুরি পোস্টডক'-এর তালিকায়। বাংলার শিক্ষাদুনিয়া তাঁর নাম না চিনলেও, বিশ্বের উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে তিনি একের পর এক চিহ্ন তৈরি করেছেন নিঃশব্দে।

রীতুপর্নার জীবনকাহিনি যেন এক নির্ভীক স্বপ্নদ্রষ্টার জয়গাথা। তিনি একদিকে যেমন কম বয়সে বিয়ে করে ফেলার চাপ আর সামাজিক গঞ্জনার বিরুদ্ধে এক রুদ্ধশ্বাস সংগ্রাম, তেমনই অন্যদিকে বিশ্বমানের গবেষণা, স্কলারশিপ আর আত্মনির্ভরতার এক অনবদ্য উদাহরণ।

বস্টনের এমআইটি ক্যাম্পাসের সামনে রীতুপর্না।

কৈশোরেই অপমানের কাঁটা 

স্কুলে পড়ার সময় থেকেই চারপাশের সমাজ, পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকি আত্মীয়স্বজনরা পর্যন্ত রীতুপর্নাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাঁর ভবিষ্যৎ বড়জোর রেলের গ্রুপ-ডি চাকরি করা কোনও যুবকের সঙ্গে বিয়ে করে সংসার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার মধ্যেই কিশোরী বেলায় এসেছিল প্রেম। সেই প্রেমিকই অবশ্য বর্তমানে স্বামী। নাম অর্ঘ্য। তবে সে সময়ে অর্ঘ্যর সঙ্গে কোচিং পালিয়ে ধরা পড়ার পরে, মোটেই কেউ ছেড়ে কথা বলেনি। নেমে আসে সমাজের চিরচেনা তিরস্কার, 'ছোট জাতের মেয়েদের তো এটাই হয়!'

অথচ সেই সমাজ থেকেই, সেই সমাজের কাঁটা, কাদা, ক্লেদ পেরিয়ে, এই 'ছোট জাতের' মেয়েই আজ নিজের যোগ্যতায় পৌঁছে গেছেন ইউরোপ, আমেরিকা, এমনকি হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল পর্যন্ত!

লড়াইয়ের অস্ত্র শিক্ষা

সালটা ২০১২। রীতুপর্নার সাফল্যযাত্রা শুরুর প্রথম ধাপটি ছিল, শ্যামনগর বালিকা বিদ্যালয় থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে, কলকাতার লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে মাইক্রোবায়োলজিতে অনার্স পড়ার সুযোগ পাওয়া। তারপরেই বিশ্বমানের Erasmus Mundus প্রোগ্রামের আওতায় Horizon 2020 স্কলারশিপে পড়াশোনা করার সুযোগ পান পোল্যান্ডের Warsaw University of Life Sciences-এ।

এই স্কলারশিপের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, তা সে সময়ের অনেক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসারের বেতনের থেকেও বেশি ছিল! তখনই রীতুপর্না বুঝতে পেরেছিলেন, সুযোগ বারবার আসে না। জান লড়িয়ে দিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পরিশ্রমের ফলও ফলেছিল।

হার্ভার্ড থেকে নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার

এরপর রীতুপর্না ২০১৮ সালে ইতালির সরকারি স্কলারশিপে ইউনিভার্সিটি অফ ভেরোনা থেকে পিএইচডি করেনন স্টেম সেল নিয়ে। পাশাপাশি গিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ পিসা-তে, সরকারি খরচে। এরপর পেয়েছেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল থেকে পেইড ইন্টার্নশিপ। সেখানে কাজ করেছেন এক নোবেল বিজয়ীর অধীনে, যিনি হার্ভার্ডের ইমিউনোলজি বিভাগের ডিরেক্টর!

এসবের মধ্যেই তাঁর অ্যাকাডেমিক প্রোফাইল ফিচার করা হয়েছে নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে, যেখানে জায়গা পাওয়া বহু তারকার কাছেও স্বপ্নের মতো। তবে রীতুপর্না ততদিনে বুঝে গেছেন, শুধু যে গল্প সত্যি হয় তা নয়, স্বপ্নও সত্যি হয়। যদি সে স্বপ্ন জেগে দেখা যায়!

No photo description available.

বিশ্বজুড়ে গবেষণা, সম্মান 

রীতুপর্না ২০২৩ সালে তাঁর সেই স্বপ্নের প্রথম পোস্টডক করেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার থেকে। সেখানে জিন থেরাপি নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে মাধ্যমে নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার চিকিৎসারও সুযোগ পান। পড়াশোনা ও কাজের সূত্রেই ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের ১৮টি দেশ, আর আমেরিকার নানা শহরে। কেমব্রিজ থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস, হাওয়াই থেকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন-- সারা বিশ্বকে যেন নিজের ডানায় মুড়ে নিয়েছেন, কেবল মেধা আর পরিশ্রমের জোরে।

এরপর দ্বিতীয় পোস্টডকে পেয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক মারি কুরি ফেলোশিপ। এই ফেলোশিপের আওতাতেই এবার তিনি কাজ করবেন ক্যানসার নিয়ে। এসবের মধ্যেই সেরেছেন বিয়ে। তারপরে এখন তিনি যাচ্ছেন স্পেনে পোস্টডক করতে, শ্বশুরবাড়ির অদম্য সমর্থন নিয়ে।

গল্প হলেও সত্যি

রীতুপর্না নিজেই আক্ষেপ করে বলেন, 'আমার গল্পটা আজও কোনও সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। যেখানে পালিয়ে বিয়ে, ধর্ষণ, অ্যাক্সিডেন্টের মতো এত নেগেটিভ খবর ছাপা হয়, জেলার সেরা নম্বর পাওয়ার মতো খবর নিয়েও আনন্দ করা হয়, সেখানে এই নম্বরবিহীন সাফল্যগুলো সামনে আসে না। এলে হয়তো তা আরও অনেক মেয়েকে অনুপ্রাণিত করতে পারত!'

সব শেষে তাঁরই মতো আরও অসংখ্য মেয়ের জীবন গড়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, 'কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে তাদের সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করবেন না। নইলে আরও অনেক আক্ষেপ বাড়বে। আমার মতো মেয়েদের জীবনে, আর এই সমাজের ভবিষ্যতে অনেক আঁধার থেকে যাবে।'


ভিডিও স্টোরি