শেষ আপডেট: 12th October 2023 15:03
সুভাষ চন্দ্র দাশ, ক্যানিং: বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাদোঘাটা গ্রামের পরমান্য পরিবার। পরিবারের কর্তা জমিদার উমেশচন্দ্র পরমান্যর সাত ছেলে রাজেন্দ্র, দেবেন্দ্র, কালীপদ, নটবর, দ্বিজেন্দ্র, অতিকায় ও বিপিনবিহারী। সাত ছেলেকে নিয়েই সুখেই কাটছিল দিন।
কিন্তু ভাইফোঁটার সময় মনমরা হয়ে থাকে পরমান্য পরিবারের সন্তানরা। তাঁদের বোন নেই যে। কে তাঁদের ফোঁটা দেবে! গুরুদেব মাতৃ আরাধনার পরামর্শ দেন জমিদার উমেশচন্দ্র পরমান্যকে। স্থির হয় সাতভাইয়ের একমাত্র বোন হিসেবে বরণ করে নেওয়া হবে দেবী দশভুজাকে। জমিদার পরিবারের গুরুদেব বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর নির্দেশ মতোই ১৯০৯ সালে জমিদার উমেশচন্দ্র পরমান্যর পরিবারে চম্পারূপে পুজো শুরু হয় দেবীদুর্গার। কুলপুরোহিত সুরেন ভট্টাচার্য ও বিষ্টুপদ ঘোষালের তত্ত্বাবধানে শাস্ত্রমতে দেবীর আরাধনা শুরু হয়। পুজোর পর প্রতিমা বিসর্জন হয়ে গেলেও প্রতিদিন দেবীঘটের পুজো হয় পরমান্য পরিবারে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে পরমান্য পরিবার ভারতে চলে আসেন। সুন্দরবনের নদী-নালা ঘেরা সুন্দরবনের ছোট্ট একটি দ্বীপ ছোটমোল্লাখালি। সেই দ্বীপের হেতালবেড়িয়া গ্রামের জমিদার অহিদারি ঘোষের জমিতে বসবাস শুরু করেন পরমান্য পরিবার। রয়্যাল বেঙ্গলের ডেরায় শুরু হয় পরমান্য পরিবারের দুর্গোৎসব। জানা যায় মাতৃরূপে চিন্ময়ী চম্পার রূপদান করেছিলেন মৃৎশিল্পী সুরেন ঘরামি।
আর্থিক কারণে আচমকাই পারিবারিক এই পুজো বন্ধ হয়ে যায় ১৯৮১ সালে। পরে সে সংঙ্কট কাটলে হলে পরিবারের সদস্য প্রিয়াংশু, পবিত্র, প্রদীপ্ত, পুলকেশদের উদ্যোগে আবারও পারিবারিক দুর্গোৎসব শুরু হয় ২০১৬ সালে। পরবর্তীতে আয়লা, আমফান, ফণী, বুলবুল, ইয়াসে বারবার তছনছ হয়েছে সুন্দরবন। কিন্তু সব দুঃখকষ্টকে পাশে সরিয়ে রেখেই শারদীয়া এলে চম্পা রূপে দেবী দশভুজার আবাহনে মাতেন এলাকার মানুষ। পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন দেবী সর্বজনীন।
দ্য ওয়াল এখন হোয়াটসঅ্যাপেও। ফলো করতে ক্লিক করুন।
পরিবারের অন্যতম সদস্য পুলকেশ পরামান্য জানান, প্রায় ১১৪ বছর আগে তাঁর ঠাকুরদা উমেশচন্দ্র এই পুজোর সূচনা করেছিলেন। বাংলাদেশে। দেশভাগের পর রয়্যাল বেঙ্গলের ডেরায় নতুন করে শুরু হয় পুজো। তিনি বলেন, “সুন্দরবনের মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইটা খুব কঠিন। বছরভর কঠোর জীবন সংগ্রাম করতে হয়। পুজোর ক’টা দিন এলাকার মানুষ সব ভুলে মেতে ওঠেন। শহরের লাখ টাকা বাজেটের পুজোর জাঁকজমক হয়তো নেই, কিন্তু আন্তরিকতাই এই পুজোর অহংকার। এটা এখন আর শুধু আমাদের বাড়ির পুজো নয়, গোটা ছোট মোল্লাখালি এখন মেতে ওঠে এই পুজোয়।”
পরমান্য পরিবারের বধূ প্রতিভাদেবী জানান, পরের পর ঝড় আর করোনার তাণ্ডবে এলাকার অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছিল। তিনি বলেন, “পারিবারিক পুজোর আনন্দ যাতে শুধু পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, সে দিকে নজর দিতে হয়। পুজোর বাজেট কাটছাঁট করেই দেবীপক্ষের শুরুতে এলাকার প্রায় শতাধিক দরিদ্র মানুষকে আমরা নতুন বস্ত্র দান করি। নতুন পোশাক পরেই তাঁরা সবাই পরমান্য পরিবারের পারিবারিক পুজোয় যোগদান করেন।”
দশমীর নির্দিষ্ট ক্ষণেই দশভুজা দেবী চম্পাকে সুন্দরবনের নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। তারপর আবার একবছরের অপেক্ষা শুরু হয়ে যায় ছোট মোল্লাখালির দ্বীপের হেতালবেড়িয়া গ্রামে।