শেষ আপডেট: 7th June 2023 05:23
দূরদর্শনের সোনালি যুগের সেইসব চেনা মুখ, আজও যাঁদের ভোলা যায়নি
রূপাঞ্জন গোস্বামী
তখন ২৪ ঘন্টার নিউজ চ্যানেল ছিল না। রেডিও এবং দূরদর্শনে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর পড়া হত। টিভির পর্দায় ভেসে উঠত এই মানুষগুলির মুখ। ভারতের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জুড়ে ছিলেন এই মানুষগুলি। তাঁরা হলেন দূরদর্শনের সোনালি যুগের সেইসব সংবাদ পাঠক ও পাঠিকা ও সংযোজক। দু'দশক পরেও যাঁদের আমরা ভুলতে পারিনি।

দূরদর্শনের সোনালি যুগের সংবাদপাঠিকারা....
সালমা সুলতান,গীতাঞ্জলি আয়ার, রিনি সাইমন, নিথি রভিন্দ্রন, মঞ্জরী যোশি, শোভনা জগদীশ , মিনু তলোয়ার, সরলা মাহেশ্বরী, কমল জে বি সিং, উষা আলবুকার্ক, অবিনাশ কাউর সারিন নামগুলি পঞ্চাশ পার হওয়া ভারতবাসীদের মনে আজও গেঁথে আছে হয়তো।

সংবাদ পাঠিকাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন সম্ভবত সালমা সুলতান। ১৯৬৭ সালে দূরদর্শনের সঙ্গে যুক্ত হন সালমা। কাজ করেছেন টানা ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ইন্দিরা গান্ধী প্রয়াত হওয়ার খবর প্রথম দেশকে জানিয়েছিলেন তিনি। প্রাণপণে কান্না চেপে সেদিন তাঁর খবর পড়া শোকাতুর ভারতবাসীদের হৃদয়ে চিরতরে গেঁথে দিয়েছিল সালমা সুলতানের নাম। সারাদিন না খেয়ে একটানা জলভরা চোখে খবর পড়ে গিয়েছিলেন সালমা সুলতান।
[caption id="attachment_151801" align="alignnone" width="601"]
সালমা সুলতান[/caption]

দূরদর্শনের পর্দায় সালমা সুলতান এলেই চোখ চলে যেত তাঁর মাথার বাম পাশে গোঁজা গোলাপগুচ্ছের দিকে। বিশেষ একটি কায়দায় শাড়ির পাড় রাখতেন ঘাড়ের কাছে। কারণটা জানলে অবাক হবেন। সে যুগে সংবাদ পাঠিকারা আজকের মতো বিজনেস স্যুট তো দূরের কথা সালোয়ার কামিজও পরতে পারতেন না। শাড়ি পরতে হত বাধ্যতামূলকভাবে।
সালমার প্রত্যেকটি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ ছিল না। তাই ঘাড়ের কাছে শাড়ির পাড় আধা ঘোমটার মতো রেখে অন্য রঙের ব্লাউজকে লুকিয়ে রাখতেন। অবসরের পর সালমা দূরদর্শনের জন্য বানিয়েছিলেন বিভিন্ন সিরিয়াল। সেগুলির মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল পঞ্চতন্ত্র, সুনো মেরি কহানি, জ্বলতে সওয়াল।
[caption id="attachment_151803" align="alignnone" width="734"]
রিনি সাইমন[/caption]

রেডিওর ন্যাশনাল নিউজ থেকে ১৯৮৫ সালে দূরদর্শনে খবর পড়তে আসেন রিনি সাইমন। এসেই দর্শকের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিলেন অসামান্য কণ্ঠপ্রতিভা ও শাণিত ইংরেজি উচ্চারণ এবং সৌন্দর্যের জন্য। দর্শকদের মনে হত সিনেমা না করে রিনির খবর পড়তে আসা উচিত হয়নি। তাঁদের মতে সিনেমা জগতে গেলে আরও নাম পেতেন রিনি।
সপ্রতিভ রিনি ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। বিভিন্ন ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থার সেমিনারে তাঁর কণ্ঠ শোনা যেত। দিল্লিতে বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানের সংযোজনা করা, ধারাভাষ্য দেওয়া, বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপন ও ফিচার ফিল্মে নেপথ্যকণ্ঠ দেওয়ায় তাঁর ছিল কল্পনাতীত দক্ষতা।
[caption id="attachment_151807" align="alignnone" width="757"]
নিথি রবীন্দ্রন [/caption]

রিনির তুলনায় আর এক জনপ্রিয় সংবাদপাঠিকা নিথি রবীন্দ্রন ছিলেন একটু গম্ভীর। তখনকার দিনে 'বয়েজ কাট' স্টাইলে চুল কাটা নিথি প্রতিরাতে দূরদর্শনের পর্দায় খবর পড়তে আসতেন তাঁর অভিজাত চেহারা ও অপেক্ষাকৃত ভারী গলা নিয়ে।
সংবাদপাঠিকা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন অসামান্য ভয়েসওভার আর্টিস্ট। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ও শর্ট ফিল্মের নেপথ্যে ভারতবাসী তাঁর কণ্ঠ শুনতে পেতেন। ভারত সরকারের বিদেশমন্ত্রকের তৈরি Fifty Years of India’s Independence নামের বিখ্যাত তথ্যচিত্রটির ভাবনা নিথি রবীন্দ্রনের মস্তিস্কপ্রসূত।
[caption id="attachment_151810" align="alignnone" width="600"]
গীতাঞ্জলি আয়ার[/caption]
গীতাঞ্জলি আয়ার ছিলেন আর এক বিখ্যাত সংবাদপাঠিকা। এয়ারহোস্টেসের মতো পোশাক পরে সোজা হয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে খবর পড়তেন। চোখের পাতা ফেলতেন খুব কম। মুখে হাসি প্রায় দেখাই যেত না। কিন্তু গলার ওঠানামায় বুঝিয়ে দিতেন খবরের গুরুত্ব।
[caption id="attachment_151812" align="aligncenter" width="470"]
উষা আলবুকার্ক[/caption]


বিভিন্ন ইংরেজি ম্যাগাজিনে লিখতে লিখতে সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন এবং দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকা হয়ে ওঠেন উষা আলবুকার্ক। পরবর্তীকালে দূরদর্শনের বিভিন্ন নিউজ ফিচার, টক-শো, কুইজ, এয়ারফোর্সের এয়ার-শোতে ধারাভাষ্য দিয়েছেন,সংযোজনা করেছেন। তাঁর অনবদ্য কন্ঠকে ব্যবহার করেছে পর্তুগিজ ব্যাঙ্ক থেকে ব্রাজিলের টিভি।
[caption id="attachment_151814" align="aligncenter" width="738"]
অবিনাশ কাউর সারিন[/caption]
অবিনাশ কাউর সারিন প্রথমে দূরদর্শনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সূত্রধর ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই চলে আসেন প্রধান সংবাদপাঠিকার ভূমিকায়। তিনি সে যুগে তিনি ছিলেন বিরল শ্রেণির সংবাদপাঠিকা যিনি সংবাদের শুরুতে ও শেষে স্মরণীয় একটি হাসি হেসে দর্শকদের অভিবাদন জানাতেন।

[caption id="attachment_151818" align="aligncenter" width="537"]
সরলা মাহেশ্বরী[/caption]
সে যুগের আর একজন বিখ্যাত সংবাদপাঠিকা ছিলেন সরলা মাহেশ্বরী। অসামান্য সৌন্দর্য কিন্তু অতিসাধারণ অথচ মার্জিত পোশাক। কোনও ধরনের অলঙ্কার ব্যবহার করতেন না। তাঁর থুতনিতে থাকা একটি বড় তিল তাঁকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলত। খবর পড়ার সময় তাঁকে সাধারণত ভাবলেশহীন লাগত। কিন্তু তিনি একবার হাসলে বুকের রক্ত চলকে উঠত না সেই সময়ের কোনও পুরুষ হলফ করে বলতে পারবেন না।

[caption id="attachment_151820" align="aligncenter" width="400"]
মিনু তলোয়ার[/caption]
প্রায় ৩৫ বছর ধরে দূরদর্শনের সংবাদপাঠিকা ও নানান অনুষ্ঠান সংযোজনার দায়িত্বে ছিলেন মিনু তলোয়ার। অনেকটা কম বয়েসের ছায়াদেবীর মতো দেখতে মিনুকে বাঙালি ঘরের মেয়ে বলে মনে হত।
[caption id="attachment_151920" align="aligncenter" width="454"]
মঞ্জরী যোশী[/caption]
কেমিস্ট্রির স্নাতক মঞ্জরী যোশীর ছিল রাশিয়ান ভাষার উচ্চতর ডিগ্রি। বহু বই ও পত্রপত্রিকার অনুবাদ করেছেন। পেশাদার দোভাষী হিসেবে কাজও করেছেন।কিন্তু ভারত চেনে তাঁকে এক অসামান্য সংবাদপাঠিকা হিসেবে।


সংবাদপাঠের ময়দানে পিছিয়ে ছিলেন না পুরুষরাও
১৯৭০-এর দশকে প্রায় এক লাখ আবেদনকারীর মধ্য থেকে সংবাদপাঠক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল স্বামী নারাঙ্গকে। উচ্চমানের উচ্চারণ ও ভরাট কণ্ঠের অধিকারী স্বামী নারঙ্গ ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে হয়ে উঠেছিলেন 'দূরদর্শনের মুখ'। ভারতবর্ষের বিভিন্ন মেট্রো রেলের হিন্দি ঘোষণাগুলির নেপথ্যে আছে এই স্বামী নারাঙ্গের কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর।
[caption id="attachment_151824" align="aligncenter" width="480"]
স্বামী নারাঙ্গ[/caption]

দূরদর্শনের পর্দায় সংবাদ পাঠের আগে রামু দামুদরন স্ক্রিপ্টে চোখই বোলাতেন না। সরাসরি নিঁখুতভাবে বলতে শুরু করতেন না দেখা স্ক্রিপ্ট। সংবাদ পাঠে এতটাই দক্ষ ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে সংবাদপাঠকের কাজ ছেড়ে নরসিমা রাওয়ের প্রাইভেট সেক্রেটারি হয়েছিলেন রামু দামুদরন। ভারতীয় কূটনীতিক হয়ে মস্কো ও আমেরিকাতে দীর্ঘদিন কাজও করেছেন।
[caption id="attachment_151828" align="alignnone" width="739"]
রামু দামুদরন[/caption]

আশি ও নব্বইয়ের দশকের আর এক বিখ্যাত সংবাদপাঠক ছিলেন তেজেশ্বর সিং। বলিষ্ঠ গঠন চাপদাড়ি ও ভরাট ভারী গলার আওয়াজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন রাশভারী ব্যক্তিত্বের অধিকারী তেজেশ্বর। ইংরেজিতে বেশিরভাগ সময় খবর পড়তেন রিনি সাইমনের সঙ্গে।
[caption id="attachment_151830" align="aligncenter" width="281"]
তেজেশ্বর সিং[/caption]

ছিপছিপে চেহারা কিন্তু চোস্ত ইংরেজি উচ্চারণ ও ভরাট গলার সুনীত ট্যান্ডন সংবাদপাঠক হিসেবে দূরদর্শনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন ২০০৭ পর্যন্ত। সারা ভারত চিনত তাঁকে, যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন এই সংবাদপাঠক।
[caption id="attachment_151832" align="alignnone" width="733"]
সুনীত ট্যান্ডন[/caption]

বেদ প্রকাশ ছিলেন দূরদর্শনের আর একজন সুপরিচিত সংবাদপাঠক ও কণ্ঠশিল্পী। পরবর্তীকালে Student Today ম্যাগাজিনের চিফ এডিটর হয়েছিলেন। খবর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন বিখ্যাত খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিনগুলিতে।
[caption id="attachment_151834" align="aligncenter" width="538"]
বেদ প্রকাশ[/caption]

১৯৭৪ সাল থেকে দূরদর্শনে সঙ্গে ছিলেন বিনোদ দুয়া। এক চ্যানেলের দূরদর্শন যুগ থেকে আজকের স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যুগ, দাপটের সঙ্গে রয়ে গেছেন সেই সময়ের সঙ্গী প্রণয় রায়ের সঙ্গে। ভারতের বিভিন্ন নির্বাচনের আগে ও ফল ঘোষণার দিন দূরদর্শনের পর্দায় হৃদকম্প ধরানো উত্তাপ নিয়ে আসার মূল কারিগর ছিলেন এই দু 'জন। যা আজকে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলগুলি চোখ বুজে অনুসরণ করে চলেছে। ভোটের পরে প্রণয় রায় ও বিনোদ দুয়া জুটির বিশ্লেষণ শোনার জন্য মুখিয়ে থাকত দেশ।
[caption id="attachment_151837" align="aligncenter" width="602"]
প্রণয় রায় এবং বিনোদ দুয়া[/caption]
দূরদর্শনের সোনালি যুগের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় পুরুষ ছিলেন বিখ্যাত ইএনটি স্পেশালিস্ট ডঃ নরোত্তম পুরী। দূরদর্শনের দেখানো বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলার সরাসরি সম্প্রচারগুলিতে ধারাভাষ্যকার হিসেবে তাঁকে দেখা যেত তিন দশক ধরে।
[caption id="attachment_151842" align="aligncenter" width="306"]
ডঃ নরোত্তম পুরী[/caption]
জানি লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়নি আরও অনেক বিখ্যাত নাম। কিন্তু লেখায় না থাকলেও হৃদয় থেকে বাদ পড়েননি তাঁরা। আজও মনের আকাশে চাঁদোয়া হয়ে রয়েছেন সাদাকালো টেলিভিশন যুগের সেইসব নক্ষত্রেরা। এক আকাশ নক্ষত্র থেকে মাত্র কয়েকটি নক্ষত্রকে এই নিবন্ধে তুলে আনা হয়েছিল নবীন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করাতে।

