শেষ আপডেট: 10th September 2021 10:34
শাওলিন টেম্পল: যেখানে 'যোদ্ধা' সন্ন্যাসীদের রক্তে বয় ধর্ম আর কুংফু
রূপাঞ্জন গোস্বামী
খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ভাগ, চিন তখন শাসন করছে ওয়েই রাজবংশ। ভারত থেকে সুদূর চিনে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে গিয়েছিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী বুদ্ধভদ্র। চিনের হেনান প্রদেশের এক পাহাড়ি উপত্যকাকে ঘিরে থাকা জঙ্গল, ঝরনা আর অনুচ্চ পর্বতশ্রেণীর অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। লোকালয় থেকে অনেক দূরে পবিত্র 'সং' পর্বতশ্রেণির গুহায় তপস্যা করতে শুরু করেছিলেন সন্ন্যাসী বুদ্ধভদ্র।প্রবর্তিত হল বৌদ্ধধর্মের 'চান' শাখা
সন্ন্যাসী বুদ্ধভদ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন প্রচুর স্থানীয় মানুষ। বুদ্ধভদ্রকে তাঁরা ডাকতেন 'ফতুও বাতুও লুও' নামে। সম্রাট জিয়াওয়েন স্বয়ং ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ। বুদ্ধভদ্রের উপাসনা পদ্ধতি অবলম্বন করে চিন দেশে শুরু হয় বৌদ্ধধর্মের 'চান' বা 'জেন' শাখা। এই 'চান' বা 'জেন' শব্দ দু'টি এসেছে সংস্কৃত শব্দ 'ধ্যান' থেকে। এই মতাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন ধ্যান ও আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে বোধি বা নির্বাণ লাভ করা যায়। [caption id="attachment_153525" align="alignnone" width="980"]

মনের ভক্তির সঙ্গে মিশল শারীরিক শক্তি
শাওলিন মনাস্ট্রির প্রথম প্রধান বুদ্ধভদ্র, ঈশ্বর সাধনার সঙ্গে মানসিক ও শারীরিক শক্তির সাধনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। জঙ্গল পরিবেষ্টিত জায়গায় অবস্থিত মন্দিরটিকে দস্যু ও বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। তাই তিনি তাঁর দুই প্রধান শিষ্য হুইগুয়ান ও সেংচাউ-এর মাধ্যমে ভারতীয় মার্শাল আর্টের সঙ্গে নিখুঁত ভাবে মিশিয়ে দেন চাইনিজ মার্শাল আর্ট। দুই দেশের দুই ধারার মার্শাল আর্টের মিলনে তৈরি হয় শাওলিন গং ফু বা শাওলিন উইউশু বা শাওলিন কুয়ান নামে এক অবিশ্বাস্য শৈলীর মার্শাল আর্ট। তাই আজ বৌদ্ধ মন্দির হয়েও শাওলিন টেম্পলের বিশ্বজোড়া খ্যাতি কিন্তু পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে ঐতিহ্যশালী মার্শাল আর্ট স্কুল হিসেবে। [caption id="attachment_153532" align="alignnone" width="1300"]
শাওলিনে এলেন বোধিধর্ম
বুদ্ধভদ্রের মহাপ্রয়াণের পর শাওলিন মনাস্ট্রি পরিচালনার দায়িত্ব পান আর এক ভারতীয় বৌদ্ধভিক্ষু বোধিধর্ম বা পুতিডামো। এই দায়িত্ব নেওয়ার আগে বোধিধর্মও শাওলিন মনাস্ট্রির ঠিক পিছনের পাহাড়টির নির্জন এক গুহায় দীর্ঘ ন'বছর তপস্যা করেছিলেন। সেই জন্য তাঁর ছায়া নাকি গুহার দেওয়ালের পাথরে চিরস্থায়ীভাবে বসে গিয়েছিল। সেই ছায়া খোদাই করা প্রস্তরখণ্ডটি আজও শাওলিন টেম্পলে সংরক্ষিত আছে। বোধিধর্মর শিষ্য হুইকে মার্শাল আর্টে পারদর্শী ছিলেন। বোধিধর্ম ও হুইকে মিলে শাওলিন ধারার কুংফুতে আরও অনেক শৈলীর সংযোজন ঘটিয়ে ছিলেন। [caption id="attachment_153535" align="aligncenter" width="800"]

কেবল তপস্যা নয়, প্রয়োজনে দেশ ও ধর্ম বাঁচাতে নামতে হবে যুদ্ধেও
দেড় হাজার বছর ধরে শাওলিন টেম্পলে আপাতবিরোধী দু'টি ধারা চান ও কুয়ান একই নদীর স্রোতের আকারে একসঙ্গে বয়ে চলেছে। বৌদ্ধ ধর্মের 'চান' শাখার সন্ন্যাসীরা বিশ্বাস করেন আত্মরক্ষা ও দেশরক্ষার প্রয়োজনে যুদ্ধে নামতে হবে। তাই দেশ ও ধর্মের বিপদে বহুবার যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন শাওলিন সন্ন্যাসীরা। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে কয়েকশো ডাকাত রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করেছিল শাওলিন টেম্পল। সন্ন্যাসীদের কুংফু প্রশিক্ষণ তখন গোপনে দেওয়া হত, তাই ডাকাতরা জানত না একের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ে শাওলিন সন্ন্যাসীদের আলৌকিক দক্ষতার কথা।


শাওলিন কুংফু শৈলী
শাওলিন মনাস্ট্রির শুরুর প্রথম কয়েকশো বছর ১০০০ টি শৈলীর কুংফু অভ্যাস করতে হত সন্ন্যাসীদের। কুইং রাজবংশের রাজত্বকালে শাওলিন সন্ন্যাসীরা ১০০০ টি শৈলী থেকে বেছে নেন সেরা ১০০ টি কুংফু শৈলী। পরবর্তীকালে ১০০ টি কুংফু শৈলী থেকে সেরা ১৮টি কুংফু শৈলী বেছে নেওয়া হয়। শাওলিন গং-ফু শৈলীগুলির মধ্যে মিশে আছে হাত ও পায়ের বিভিন্ন মুদ্রা, যেগুলি উপাসনা পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শৈলিগুলির মধ্যে মিশে আছে বিভিন্ন জীবজন্তুর আক্রমণ ও আত্মরক্ষার নানা ভঙ্গিমা।

কীভাবে প্রচারে এল শাওলিন!
শাওলিন টেম্পল নিজেকে প্রচারের আলোর বাইরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল মাত্র তিন দশক আগেও। কিন্তু ১৯৭৮ সালে হংকং থেকে তৈরি হওয়া একটি চলচ্চিত্র The 36th Chamber of Shaolin শাওলিন টেম্পলের সন্ন্যাসীদের মার্শাল আর্টে অবিশ্বাস্য দক্ষতার কথা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে। এরপর দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে শাওলিন টেম্পলের নাম। বিদেশি পর্যটকদের কাছে শাওলিন টেম্পল হয়ে ওঠে জনপ্রিয় একটি পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু-কিশোর-তরুণ এসে হাজির হয় শাওলিন টেম্পলে কুংফু শেখার জন্য। [caption id="attachment_153553" align="aligncenter" width="533"]
শাওলিন টেম্পলের রোজনামচা
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মার্শাল আর্ট স্কুলে টিকে থাকা মোটেই সহজ কাজ নয়। অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু হলে, প্রচুর ধৈর্য ও নিষ্ঠা থাকলে তবেই শাওলিন টেম্পল থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে বেরোনো সম্ভব। প্রত্যেকটি দিনকে চারটি ভাগে ভাগ করে চলে কঠোর ধ্যান, ধর্মশিক্ষা, কুংফু শিক্ষা ও প্রথাগত শিক্ষাদান।


