খনি এলাকার পরিদর্শনে ডব্লউবিপিডিসিএলের চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর আইএএস ডক্টর পিবি সেলিম।
শেষ আপডেট: 7th February 2025 19:51
রফিকুল জামাদার এবং সুমন বটব্যাল
অবশেষে তিন দশক পর বীরভূমের দেউচা পাচামিতে হইহই করে কয়লা খনি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। বুধবার বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চ থেকেই এই কয়লা উত্তোলনের ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তারপরই বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে কয়লা উত্তোলনের কাজ। জেলাশাসক, পুলিশ সুপারের পাশাপাশি শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন শীর্ষ প্রশাসনের একাধিক কর্তা। এদিন দেউচা-পাচামি খনি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন ডব্লউবিপিডিসিএলের চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর আইএএস ডক্টর পিবি সেলিম।
পরে দ্য ওয়ালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ডব্লউবিপিডিসিএলের চেয়ারম্যান বলেন, "দেউচা-পাচামি কয়লা ব্লক পৃথিবীর অন্যতম বড় কয়লা খনি প্রকল্প। এটা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জিং প্রকল্প। এই খনি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে সার্বিকভাবে বাংলার অর্থনীতির ভোলবদলে যাবে।"
কেন এমন দাবি করছেন প্রশাসনিক কর্তা? নবান্ন সূত্রের দাবি, দেউচা পাচামির প্রথম ২০ মিটারে রয়েছে মাটি। পরের ২৮০ মিটার জুড়ে রয়েছে ব্যাসাল্ট বা ব্ল্যাক স্টোন। তার নীচের অংশে অর্থাৎ মাটি থেকে ৩০০ মিটার থেকে ১ হাজার মিটার জুড়ে রয়েছে শুধুই কয়লা।
নবান্নের এক কর্তার কথায়, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের চেয়েও এটি বড় প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যে প্রায় ১ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
তিনটি ধাপে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে চাইছে রাজ্য। মাটি তোলার পর প্রথমে তোলা হবে ব্যাসাল্ট। তারপরে কয়লা। সেলিম বলেন, "তারপরে যে অংশে কয়লা তোলার ক্ষেত্রে অসুবিধা থাকবে সেখানে আমরা কয়লাকে গ্যাস হিসেবে ব্যবহার করব।"
ডব্লউবিপিডিসিএলের চেয়ারম্যান তথা এমডি বলেন, "আন্ডারগ্রাউন্ডে কেমিক্যালের সাহায্য কয়লাকে গ্যাসে রূপান্তরিত করা হবে। এখান থেকে আমরা ৬ ধরনের গ্যাস পাব। অ্যামোনিয়াম, নাইট্রোজেন, মিথেন, কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং হাইড্রোজেন। এই গ্যাসগুলি বিভিন্ন শিল্প সংস্থার কাজে ব্যবহার করা হবে।"
প্রশাসন সূত্রের খবর, দেউচা পাচামিতে প্রায় ১২০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা এবং ২৪০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ব্যাসাল্ট আছে। স্বভাবতই বিপুল পরিমাণ কয়লা এবং ব্যাসাল্ট উত্তোলন হলে বাংলার অর্থনীতির ভোল বদলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
ইতিমধ্যে এই বিপুল পরিমাণ কয়লা উত্তোলনের জন্য রাজ্যের তরফে গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হয়েছে। সেলিম জানান, দেশ বিদেশের বহু সংস্থা ইতিমধ্যেই ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ৩ মার্চ টেন্ডার জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। তারপরই পুরোদ্যমে কয়লা উত্তোলনের কাজ শুরু হবে।
দেউচা পাচামি খনি প্রকল্প এলাকায় রয়েছে ৪ হাজার ৮৩০টি বাড়ি। জনসংখ্যা প্রায় ২৩ হাজার। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ জনজাতির। নবান্নের দাবি, এলাকার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ লিখিতভাবে সম্মতি জানিয়েছেন। বাকিরাও প্রক্রিয়ায় রয়েছেন।
প্রশাসনের দাবি, গত তিন বছর ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিপূরণের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। শুধু জমির মালিকই নয়, ক্ষতিপূরণের প্যাকেজের সুবিধা পাবেন সংশ্লিষ্ট জমির ভাগ চাষি, পাট্টাদার, মজুররাও। সেলিম বলেন, "সরকারের তরফে ক্ষতিপূরণের সবচেয়ে লাভজনক প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। বিঘা প্রতি ১৩ লাখের বেশি টাকা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও প্রতি পরিবার পিছু সরকারি চাকরি দেওয়া হচ্ছে।"
প্রসঙ্গত, দেউচা পাচামি নিয়ে বহু দিন ধরেই ঝামেলা চলছে পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৯৩-৯৫ সালে, বাম শাসনের আমলে দেউচা পাচামি-সহ তিনটি কয়লা ব্লক বণ্টন করা হয়েছিল আরপি-সঞ্জীব গোয়েঙ্কা গ্রুপকে। তবে সরকারি তরফে ব্লক পেলেও, উত্তোলনের পরিবেশ গড়ে তোলা যায়নি বহু বছর ধরে। কয়লা খনি উত্তোলনে স্পেশালাইজড সংস্থা হিসেবে পরিচিত কোল ইন্ডিয়া। ২০০৩ সালে তাদের দেউচা পাচামির দায়িত্ব দিয়েছিল পূর্বতন বাম সরকার। তবে তা করতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৩ সালে প্রকল্প থেকে হাত তুলে নেয় কোল ইন্ডিয়া। পরবর্তীকালে এই দেউচা পাচামি কয়লা খনি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভীষণই আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে রাজ্য জয়েন্ট ভেঞ্চারে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব নিলেও তা ব্যর্থ হয়। ২০১৯ সালে ফের উদ্যোগী হয় রাজ্য। অবশেষে ২০২১ সালের শেষ থেকে পুনর্বাসন প্যাকেজের মাধ্যমে শুরু হয় জমি অধিগ্রহণের কাজ। প্রায় চার বছর পর তা সম্পন্ন হয়েছে।
এবার পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়েছে কাজ। অচিরেই যা সার্বিকভাবে বাংলার আর্থিক ছবি বদলে দেবে বলে দাবি নবান্নের।