শেষ আপডেট: 3rd September 2024 13:08
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই/এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ...।' সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতোই আচমকা পুরনো শহরটা যেন আমূল বদলে গিয়েছে। আর জি কর হাসপাতালের ডাক্তার-ছাত্রীকে ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় কল্লোলিনী কলকাতার প্রতিবাদী চোখ দুটো যেন ফের জ্বলে উঠেছে। হাতে গোনা কয়েকটি পুজোর থিমের ফ্লেক্স রাস্তায় চোখে পড়লেও তৃণমূলের মাতব্বরদের পুজোর তেমন কোনও প্রচার উধাও। পুজোর আর মাত্র ৩৬ দিন বাকি থাকলেও গড়িয়াহাট, নিউমার্কেট, শ্যামবাজার-হাতিবাগান সহ শহরতলির বাজারেও নেই মাছি ভনভনে ভিড়। এমনকী আধুনিক বাঙালির জাতীয় খাবার বিরিয়ানি-চিনেপাড়ার খাবারেও অরুচির ছোঁয়া লেগেছে। একটি মেয়েকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ-খুনের ঘটনা গোটা বঙ্গসমাজের হৃদয় একেবার মুচড়ে দিয়েছে।
দুর্গাপুজো বাঙালির নয়, দেশের জাতীয় উৎসব। যার উদ্বোধন হয় গণেশ চতুর্থী থেকে। আগামী শনিবার গণেশ পুজোরও তেমন কোনও চাকচিক্য এখন থেকে দেখা যাচ্ছে না। তবে সবথেকে বেশি ছাপ পড়েছে পুজোর বাজারে। বিক্রেতাদের কথায়, শাড়ি, পোশাকের বিক্রি একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল কোভিডকালে।
পুজোর আগে মাস দুয়েকের বিক্রিবাটায় বহু মানুষের সম্বৎসরের আয়ের লক্ষ্মী ঘরে ওঠেন। কিন্তু, এবার যেন শ্মশানের শূন্যতা সর্বত্র। ক্রেতার আকাল দোকান ও মলগুলিতে, সিনেমা হলগুলিতেও গিয়ে টিকিট মিলছে। দর্শক-শূন্যতায় ভুগছে। তার থেকেও খারাপ অবস্থা রেস্তরাঁগুলির। ফ্যা ফ্যা করছে বিরিয়ানির ফেরিওয়ালারা। আগে যেসব স্ট্রিটফুড বিরিয়ানির দোকানে বিকেল থেকে ঠংঠং আওয়াজ ভেসে আসত সেখানে এখন টিমটিম করে লাল শালুতে মোড়া হাঁড়ির নীচে প্রদীপের মতো গ্যাস জ্বলে যাচ্ছে। কারণ খোলা রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উই ওয়ান্ড জাস্টিসের প্রতিবাদীরা।
গত পুজোয় গড়িয়াহাটের একটি শাড়ির দোকানের শনি-রবিবারের বিক্রি ছিল ৪ লক্ষ টাকা। গত উইকএন্ডে তা এসে ঠেকেছে ১ লক্ষে। পাশাপাশি নিউমার্কেটের একটি বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকান, যেখানে পুজোর বাজার করতে আসা লোকের ভিড়ে ১০০০ প্লেট বিক্রি হতো, এবার তা এসে ঠেকেছে মেরেকেটে ৬০০তে। একই চেহারা পার্ক স্ট্রিট ও চিনেপাড়াতেও।
এক দোকান কর্মচারী বললেন, কোভিডকাল ছিল মানুষের হাতের বাইরে। কিন্তু এবার যেন কেনাকাটায় মনই নেই মানুষের, বিশেষ করে ইয়ং জেনারেশনের। তিনিও স্বীকার করলেন, আর জি করে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত খারাপ। এর সুবিচার চাই। কিন্তু, বিক্রি না হলে আমরা খাবো কী? এই দুমাসের বিক্রির উপর ভর করে আমাদের আয় বাড়ে।
গড়িয়াহাটের আরেকটি বড় দোকানের অভিজ্ঞতাও একই। অন্য পুজোর সময় শনি-রবিতে প্রতিদিন ২০০র বেশি শাড়ি বিক্রি হতো। এবার গত সপ্তাহে কোনওমতে ৫০টি বিক্রি করা গিয়েছে। কারণ, আন্দোলনের ফলে প্রায় রোজই কলকাতার অধিকাংশ বড় রাস্তা অচল হয়ে যাওয়া। কিংবা কেউ জানেন না, কখন কোন রাস্তায় মিছিল বেরিয়ে পড়বে। তার থেকেও বড় কথা, এই প্রথম দেখা গিয়েছে, মিছিলের কারণে যানজট হলেও মানুষ কোথাও বিরক্তি প্রকাশ করছেন না। কিংবা কয়েকবারের মতো সঙ্ঘবদ্ধভাবে অবরোধ তুলতে বাস থেকে নেমে পড়ছেন না।
কলকাতার দুটি চেন রেস্তরাঁ অন্যান্যবার এই সময়ে অতিরিক্ত লোক চুক্তি হিসেবে নিয়োগ করে থাকে। এবার সেই অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত এখনও পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। এমনকী এই অবস্থা চলতে থাকে কর্মীদের পুজো বোনাস দেওয়া যাবে কিনা তা নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। ব্যবসায় প্রায় ৩০ শতাংশ মন্দা দেখা দিয়েছে। মন্দা রয়েছে অনলাইন বিক্রিতেও। হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সভাপতি সুদেশ পোদ্দার জানান, গত ৮-১০ দিনে অধিকাংশ রেস্তরাঁর ৫০ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। মানুষের এখন আমোদপ্রমোদে খরচেও মন নেই।
পার্ক স্ট্রিটের একটি বড় রেস্তরাঁর কর্তৃপক্ষ জানায়, বহু লোকের মধ্যেই বাইরে খাওয়ার মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি হচ্ছে। নতুন জিনিস কিনতে চাইছে না। অনেক সময় চক্ষুলজ্জাতেও এসবে খরচ করতে ভয় পাচ্ছেন। ফলে শুধুমাত্র কিছু ক্লাবের সরকারি অনুদান ফেরতের মধ্য দিয়েই প্রতিবাদী হচ্ছে না কলকাতা, পুজোর মতো প্রাণের উৎসবেও যেন সেই স্পন্দন ফিরে পাচ্ছে না বাঙালি। যে উৎসবে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়, এবার সেই পুজোতেও জাস্টিসের দাবিতে 'লক্ষ্মীছাড়া' হতে চলেছে বঙ্গ-বাণিজ্য।