শেষ আপডেট: 14th August 2024 00:13
সুমন বটব্যাল
বগটুই কাণ্ডে ছোট আঙারিয়ার ছায়া দেখছেন সিবিআইয়ের প্রাক্তন আইনজীবী তাপস বসু।
টিভির পর্দায় মঙ্গলবার বগটুই গণহত্যা মামলার গতিবিধি দেখে সিবিআইয়ের প্রাক্তন দুঁদে আইনজীবী তাপস বসুর স্মৃতিতে ভেসে উঠছে দু'দশক আগের বহুচর্চিত ছোটআঙারিয়া গণহত্যা মামলার স্মৃতি। সন্ধেয় টেলিফোনে দ্য ওয়ালকে তাপস বসু জানালেন তাঁর উপলব্ধির কথা। বললেন, "জমানা বদলায়, শাসকও বদলায়, কিন্তু ট্র্যাডিশন বদলায় না!"
কী সেই ট্র্যাডিশন, জানতে হলে দু'দশক আগের ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরতে হবে!
মেদিনীপুর জেলা আদালতে সিবিআইয়ের আইনজীবী তাপস বসু ও মামলার মূল সাক্ষী বক্তার। ফাইল ছবি।
২০০১ সালের ৪ জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার ছোট আঙারিয়া গ্রামে তৃণমূলের ৫জন কর্মীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল তৎকালীন শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে। ওই মামলায় সিপিএমের তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা তপন ঘোষ, সুকুর আলি-সহ একাধিকজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন তৃণমূল কর্মী বক্তার আলি মণ্ডল।
তাপসবাবু বলেন, "১৪ বছর সিবিআইয়ের হয়ে একাধিক মামলা লড়েছি। তবে ছোটআঙারিয়া মামলার কথা কখনও ভুলতে পারব না। মামলার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একাধিক চাপ এসেছে। তা সত্ত্বেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মামলা এগিয়ে নিয়ে গেছি। কিন্তু সাক্ষ্যগ্রহণ পর্বে মেদিনীপুর আদালতে দাঁড়িয়ে নিজের মৃত স্বামীকেই চিনতে পারেননি কাশ্মীরা বিবি। গণহত্যায় মৃত হায়দার আলি মণ্ডলের ছবি দেখিয়ে মেদিনীপুরের পঞ্চম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক উদয়নাথ রায়ের এজলাসে কাশ্মীরার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, দেখুন তো উনি আপনার স্বামী কিনা? বোরখা পড়ে এজলাসে এসে ছবির দিকে না তাকিয়েই উনি বলে দিয়েছিলেন, চিনতে পারছি না! সন্ত্রাসের ধরন কতটা ভয়ঙ্কর হলে স্ত্রী নিজের মৃত স্বামীর ছবি চিনতেও অস্বীকার করতে পারে, সেটা সেদিন বুঝেছিলাম।"
ওই ঘটনায় পরে মামলার মূল সাক্ষী বক্তার-সহ ২০জনকে বিরূপ ঘোষণা করেছিল সিবিআই। সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অভিযুক্ত সিপিএম নেতাদের সকলকেই নির্দোষ হিসেবে মুক্তি দিয়েছিল আদালত। জমানা বললের পর ফের আদালতে মামলাটি উঠলে মামলার প্রধান সাক্ষী বক্তার আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারককে বলেছিলেন, “খুনের হুমকি দিয়ে আমাকে মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সত্যি বললে আমার স্ত্রী, সন্তানদের খুন করা হবে। ধর্মাবতার, তাই বাধ্য হয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আমি মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম।”
তাপসবাবু বলেন, "বগটুইয়ের ক্ষেত্রেও একই হচ্ছে। তা না হলে যাঁদের পরিবারের ১০ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেল, তাঁরা কীভাবে আদালতে এসে বলে, অভিযুক্তকে চিনতে পারছেন না। অথচ ওরাই ঘটনার সময় অভিযুক্তদের নামে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছিল! তাহলে ভাবুন অবস্থাটা কী!"
২০২২ সালের ২১ মার্চ বোমা মেরে খুন করা হয়েছিল বীরভূমের রামপুরহাটের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখকে। পাল্টা হিসেবে ভাদুর অনুগামীরা ওই রাতেই পাশের বগটুই গ্রামে পরপর বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ হয়ে মারা যান ১০জন। বগটুইয়ে গণহত্যার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে তৃণমূলের ১ নম্বর ব্লকের সভাপতি আনারুল হোসেনকে দায়ী করেছিলেন মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পলাতক আনারুলকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।প্রধান অভিযুক্ত আনারুল-সহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনও হয়েছে। কিন্তু মঙ্গলবার সাক্ষ্য গ্রহণ পর্বে সেই রাতের গণহত্যার পুঙ্খানপুঙ্খ বিবরণ দিলেও স্বজনহারা মিহিলাল ও তাঁর দুই ভাই আদালতে এসে অভিযুক্তদের দেখে চিনতেই পারলেন না।
এভাবে মূল সাক্ষীদের বিরূপ হতে দেখে এদিন আদালত চত্বরেই হতাশা ঝরেছে সিবিআইয়ের আইনজীবী পার্থ তপস্বীর কণ্ঠে। অসহায় সুরে বলেছেন, "অনেকে সিবিআই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু মামলার মূল সাক্ষীরা যদি প্রতিকূলে চলে যান, তাহলে আমাদের কী করার আছে!"
তাপসবাবুর কথায়, "আসলে স্থানীয় প্রশাসনও শাসকদলের হয়ে কাজ করে। ফলে সিবিআইকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে মামলা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু মূল অভিযোগকারীরা বয়ান বদলালে তাঁদের বিরূপ ঘোষণা ছাড়া আমাদেরও কিছু করার থাকে না।"