শেষ আপডেট: 8th September 2023 11:13
জি-২০ সম্মেলনে যোগদান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্যে শুক্রবার দুপুরে দিল্লি পৌঁছেছেন বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকেলে নরেন্দ্র মোদীর সরকারি বাসভবনে দুই প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে বসবেন। সেই বৈঠক শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক বাদেই বৈঠক এবং একসঙ্গে নৈশভোজ করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চিন এবং রাশিয়া এক দিকে দাঁড়িয়ে। তারা খোলাখুলি হাসিনা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, আমেরিকা নানাভাবেই বর্তমান সরকারকে চাপে ফেলতে তৎপর। তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। উপ মহাদেশে একটা সময় পাকিস্তানকে সামনে রেখে যেভাবে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলি অঙ্গুলিহেলনের চেষ্টা করত, বিগত কয়েক বছর যাবৎ সেই দড়ি টানাটানির খেলাই শুরু হয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে মোদী-বাইডেন বৈঠকেও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠবে কি না তা নিয়েও তীব্র কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
কূটনৈতিক মহলের একাংশ মনে করে মার্কিন চাপের মুখে বাংলাদেশ পুরোপুরি চিনের দিকে ঝুঁকে পড়লে তা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের জন্যই ক্ষতিকর। সবচেয়ে বিপদে পড়বে ভারত। বাইডেনকে আঞ্চলিক নিরাপত্তার এই দিকটি বুঝিয়ে বলবেন মোদী, আশাবাদী বাংলাদেশের কূটনৈতিক শিবির।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠবে কিনা প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তা বলেছেন, ‘আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে কথা হবে।’ এই মন্তব্য করে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, আওয়ামী লিগ সরকার না থাকলে ভারতীয় উপমহাদেশ ফের অশান্ত হয়ে উঠতে পারে জঙ্গি তৎপরতা এবং ভারত বিরোধী শক্তি আস্ফালনে। হাসিনা সরকারের দাবি, গত ১৫ বছরে এই শক্তিকে মাথা তুলতে দেয়নি বাংলাদেশ। তাতে ভারতও উপকৃত হয়েছে।
জি-২০’র বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিন। তবে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তিনি দু’দিনের সফরে এখন বাংলাদেশে রয়েছেন। এই প্রথম বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের অন্যতম সমর্থক দেশ রাশিয়ার এত বড় মাপের কোনও সরকারি কর্মকর্তা ঢাকা সফরে গিয়েছেন। শুক্রবার সকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর দুই বিদেশমন্ত্রীর যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে ল্যাভরভের মন্তব্য ঘিরে কূটনৈতিক মহলে তুমুল চর্চা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সে দেশের উপর বেশকিছু বিধি নিষেধ চাপিয়েছে আমেরিকা। চালু করেছে পৃথক ভিসা নীতি। সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার আমেরিকা সফরের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মানবাধিকার হরণের অভিযোগে। এছাড়া মার্কিন কূটনীতিকরা বিগত এক বছর যাবৎ বাংলাদেশে অবাধ ভোট করা নিয়ে সরব। অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশকে চিন-রাশিয়ার প্রভাব থেকে বের করে আনতে চাপ সৃষ্টির খেলায় আমেরিকা গণতন্ত্র, মানবাধিকারকে হাতিয়ার করেছে। অথচ, মায়ানমারে সেনা শাসকদের সম্পর্কে আমেরিকা নীরব।
এই প্রেক্ষাপটে ল্যাভরভের একটি মন্তব্য ঘিরে তুঙ্গে উঠেছে রুশ-মার্কিন বিবাদ। ঢাকায় তিনি খোলাখুলি বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা চাপ প্রয়োগ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আমাদের বন্ধুরা তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে অবিচল। যা জাতীয় স্বার্থে পরিচালিত হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা তথাকথিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ব্যবহার করে এই অঞ্চলে তাদের স্বার্থ প্রচার করার চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্টতই চিনকে নিরস্ত্র এবং এই অঞ্চলে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা।’
ল্যাভরভের এই মন্তব্য বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক বলে কূটনৈতিক মহল মনে করছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে চিন যে খোলাখুলি বাংলাদেশের পাশে আছে নানা অবকাশে তারা সে বার্তা দিয়েছে। সপ্তাহ দুয়েক আগেই জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিনের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে শি বাংলাদেশ প্রশ্নে চিন হাসিনার পাশে আছে বলে কথা দেন, দাবি বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকের।
বাংলাদেশের মাটিতে আমেরিকা ও রাশিয়ার ছায়া যুদ্ধ এবারই নতুন নয়। গত বছর ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে নিয়ে বিতর্ক চলছে। তিনি বাংলাদেশের ভোট নিয়ে সে দেশের রাজনৈতিক দলের নেতাদের ডেকে ডেকে বৈঠক করছেন। মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে সরব হয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতার সমালোচনা করে রুশ দূতাবাস এক বিবৃতি জারি করে। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্ল্যাকমেইল এবং সে দেশে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার অভিযোগ তোলা হয়। কূটনৈতিক মহলের মতে এমন বিবৃতি ছিল নজিরবিহীন। রুশ দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কিছু দেশ নিজেদের উন্নত গণতন্ত্র বলে দাবি করে। অথচ তারা অন্য সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে শুধু হস্তক্ষেপই করে না, ব্ল্যাকমেইলও করে।’ বলা হয় রাশিয়া কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না।
ইউক্রেনকে সামনে রেখে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে আমেরিকা-সহ পশ্চিমের শক্তিধর দেশগুলি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে গুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাইডেন প্রশাসন। তারফলে ভারত, বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের বহু দেশ বিপদে পড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বাণিজ্য করা যাচ্ছে না। অথচ বেশিরভাগ দেশের কাছে বৈদেশিক মুদ্রা বলতে মার্কিন ডলারই আছে।
অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধকে সামনে রেখে আরও কাছাকাছি এসেছে চিন ও রাশিয়া। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এখন অন্য উচ্চতায় বিরাজ করছে। বাংলাদেশে দুই দেশেরই বিপুল বিনিয়োগ আছে। চিন সে দেশে সেতু, হাইওয়ে ইত্যাদি পরিকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হয়েছে রাশিয়ার অর্থ সাহায্যে। বিনিয়োগ আছে ভারতেরও। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মোদী-হাসিনা এবং মোদী-বাইডেন বৈঠক দু-দেশের সম্পর্ক ছাপিয়ে চিন-রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার ছায়া যুদ্ধেও প্রভাব ফেলবে, মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা।
হাসিনাকে রাজস্থানী লোকগানে স্বাগত জানানো হল নয়াদিল্লিতে, বৈঠক নিয়ে টুইট মোদীর