বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
শেষ আপডেট: 8th August 2024 11:49
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ১৯৬৮-র জুন মাস। দলের যুব সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বঙ্গ সিপিএম। ত্যাগরাজ হলে সম্মেলনের প্রস্তুতি, রাজনৈতিক প্রতিবেদন তৈরির ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন দীনেশ মজুমদার। কিন্তু নতুন সংগঠনের সম্পাদক কে হবেন?
দক্ষ সংগঠক দীনেশকে পার্টির কাজে পাশে চান পিডিজি, অর্থাৎ প্রমোদ দাশগুপ্ত। আবার রাজ্যে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফ থেকে সর্ব ভারতীয় সংগঠন এসএফআই গঠনের সলতে পাকানো শুরু হয়েছে। নেতৃত্বে থাকবেন বিমান বসু। রাজ্যে ছাত্র সংগঠনের দায়িত্ব সামলাবেন শ্যামল চক্রবর্তী ও সুভাষ চক্রবর্তী। ষাটের দশকে এই চার ফায়ার ব্রান্ড ছাত্র-যুব নেতার কাঁধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকায় প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত এক বলিয়ে কইয়ে ঝকঝকে তরুণকে নতুন যুব সংগঠন ডিওয়াইএফ-র সম্পাদক করার সিদ্ধান্ত হয়। জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনের সামনের সারিতে এই তরুণকে দেখা যায়নি। পরিস্থিতির সমীকরণে ত্যাগরাজ হলের সম্মেলন থেকে ডিওয়াইএফ-র সম্পাদক হিসাবে এই তরুণকে বেছে নেওয়া হল। সেই তরুণই পরবর্তী পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সম্মেলন উলক্ষ্যে শহীদ মিনারের সমাবেশে জ্যোতি বসুদের পাশাপাশি বক্তা ছিলেন বুদ্ধদেবও। রাজনীতির বড় মঞ্চে সেই প্রথম।
দলীয় রাজনীতির দীর্ঘ যাত্রাপথে সমাবেশে শেষবার দেখা গিয়েছিল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে, বামফ্রন্টের ব্রিগেড সমাবেশে। ভগ্নস্বাস্থ্য এবং অসুস্থতা সত্বেও গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার-সহ বুদ্ধদেব পৌঁছেছিলেন মঞ্চের পিছনে। কিন্তু একাধিকবার চেষ্টা করেও নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো অসুস্থ নেতাগাড়ি থেকে নামতে পারেননি। চেষ্টা করেছিলেন গাড়িতে বসেই ভাষণ দেবেন। সিওপিডির সমস্যায় জর্জরিত বুদ্ধদেবের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি।
আট এবং নয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত রাজ্য সিপিএমে বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস এবং শ্যামল ও সুভাষ চক্রবর্তীদের দাপট ছিল অনেক বেশি। যদিও ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টের প্রথম মন্ত্রিসভাতেই তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। ১৯৯৬-এ পুলিশ তথা স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্ব পাওয়ার আগে পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনও দপ্তর বুদ্ধদেবের হাতে ছিল না।
পার্টিতে বুদ্ধদেব কোনও দিনই বিমান, শ্যামল, অনিলদের মতো সংগঠন বোঝা নেতা ছিলেন না। তবে যে কোনও রাজনৈতিক, মতাদর্শগত বিতর্কে দ্রুত স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারতেন। জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক হোক কিংবা ইউপিএ-১ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার অথবা ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে বাম-কংগ্রেস জোট, প্রতিবারই নিজের অবস্থানে কোনও ধোঁয়াশা রাখেননি। পরবর্তী সময়ে তাঁর দেখানো পথেই হেঁটেছে বঙ্গ সিপিএম।
১৯৮২-র বিধানসভা ভোটে কাশীপুরে হারের পর যাদবপুর থেকে উপ নির্বাচনে জিতে মন্ত্রিসভায় ফেরেন তিনি। তথ্য সংস্কৃতির সঙ্গে কিছু দিন পুর দপ্তর সামলেছেন। তখনও পার্টি ও সরকারের তরফে কোনও আভাস ছিল না তিনিই হবেন জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি। ছবিটা বদলে যায় নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে। জ্যোতিবাবুর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে এক বছরের জন্য ফের মন্ত্রিসভার বাইরে থাকার পর ফিরে আসেন।
এদিকে, বয়স বাড়ছিল জ্যোতি বসুর। তাঁর ভার লাঘব এবং প্রশাসনে বুদ্ধদেবের জায়গা মজবুত করতে ১৯৯৬ সালে তথ্য ও সংস্কৃতির পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভারও বুদ্ধদেবকে দেওয়া হয়। এই পর্বেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের উত্থান। ১৯৯৮ সালের লোকসভা ভোটে সদ্য তৈরি চমকপ্রদ সাফল্যে স্পষ্ট হয়ে যায় জ্যোতি বসুর দীর্ঘ জমানার বিরুদ্ধে আমজনতার ক্ষোভ বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির, সংস্কৃতিমনস্ক বুদ্ধদেবকে ১৯৯৯ সালে তাই রাজ্যের উপ মুখ্যমন্ত্রী করে সিপিএম। ৩৪ বছরের বাম জমানায় ওই একবারই উপ মুখ্যমন্ত্রীর পদ তৈরি হয়েছিল।
কেশপুর, গড়বেতার পাঁশকুড়া লাইনের জেরে রাজ্যে তখন বাম জমানার পতনের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে। মাঝপথে জ্যোতি বসুর অবসর এবং বুদ্ধদেবকে মুখ্যমন্ত্রী করে মাস্টার স্ট্রোক দেয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। আসন কমলেও ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বুদ্ধদেবের উপরই আস্থা রাখে বাংলা। আর ফিরে তাকাতে হয়নি বুদ্ধদেবকে।
উল্টো দিকে অনেক আগেই পরিবহন মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ভোটে হেরে দলে কিছুটা কোণঠাসা হয়ে গিয়েছেন শ্যামল। জ্যোতি বসুর প্রিয় পাত্র হলেও নানা বিতর্কে জড়িয়ে দলের সম্পাদক মণ্ডলীতে তখনও জায়গা পাননি সুভাষ। মন্ত্রী হতে অনিল ও বিমানের বরাবরই অনীহা। আর ২০০৬-এর ভোটে বামফ্রন্টের বিপুল জয় বুদ্ধদেবকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের চালকের আসনে বসিয়ে দেয়। ২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের পরেও দীর্ঘদিন বঙ্গ সিপিএম শেষ কথা বুদ্ধদেবই বলেছেন।
রাজ্য পার্টিতে চালকের আসনে থাকলেও জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী বিতর্ক থেকেই সিপিএমের কট্টরপন্থী শিবিরের সঙ্গে বুদ্ধদেবের সংঘাত চলছিল। অধিকাংশ সময় তিনি পিছু হঠেছেন। কখনও প্রকাশ কারাট, পিনারাই বিজয়নদের পিছু হটতে হয়েছে। এই সংঘাতের কারণেই দিল্লিতে ২০০৯-এর পরবর্তী বৈঠকে মাঝেমাঝেই গরহাজির থাকতেন।
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিনেই ৩৪ বছরের বাম শাসনের দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে পলিটব্যুরো থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু পার্টি তা গ্রহণ করেননি। কিন্তু দিল্লিতে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেন বুদ্ধদেব। ২০১২- থেকে পার্টি কংগ্রেসে যাওয়াও বন্ধ করে দেন। ২০১৫-তে বিশাখাপততনম পার্টি কংগ্রেসে দলের পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও স্বেচ্ছায় সরিয়ে নেন নিজেকে। কিন্তু তাঁর চেষ্টাতেই দলের সাধারণ সম্পাদক হন অনুজ সীতারাম ইয়েচুরি।
রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপির মোকাবিলায় জোটপন্থী সীতারামকে সাধারণ সম্পাদক করেই ২০১৬ সালে রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস বোঝাপড়া গড়ে তুলতে সওয়াল শুরু করেন বুদ্ধদেব। তখনও নেতাদের বড় অংশই এমন বোঝাপড়ার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি রাজ্য পার্টির নেতৃত্বে নতুন মুখ নিয়ে আসার পক্ষেও সওয়াল করতে থাকেন। সেই ভাবনা বাস্তবায়ন ২০১৮-তে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী ও রাজ্য কমিটি থেকেও সরে যান। কমিউনিস্ট পার্টিতে এমন নজির কমই আছে।
পাশাপাশি দলের শুদ্ধকরণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন তিনি। অনিল বসু, লক্ষণ শেঠ, রেজ্জাক মোল্লা প্রমুখ বিতর্কিত নেতাদের বহিষ্কারের নেপথ্যে বুদ্ধদেবের বড় ভূমিকা ছিল। রাজ্য সিপিএমের ইতিহাসে বুদ্ধদেবের শেষ অবদান বাম-কংগ্রেস জোটকে পার্টি কংগ্রেসের শিলমোহর প্রদান।
২০১৮ সালের হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে গৌতম দেব, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ি প্রমুখ জোটপন্থীরা জোরদার লড়াই করে এই শিলমোহর আদায় করেন। সেই পার্টি কংগ্রেসে জোটের প্রশ্নেই সিপিএম প্রায় ভাঙনের মুখে চলে গিয়েছিল। ভাঙন ঠেকাতে প্রকাশ কারাট, এস আর পিল্লাই, বিজয়নদের কট্টরপন্থী শিবির পিছু হঠে। জয়ী হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের জোটপন্থী লাইন। সেদিন হায়দরাবাদ থেকে বহু দূরে পাম অ্যাভিনিউর বাড়ি থেকে বঙ্গ সিপিএমের জোটপন্থীদের ভরসা জুগিয়েছে বুদ্ধদেব। তাঁর সৌজন্যেই বাম ও কংগ্রেসের ভেঙে যাওয়া বোঝাপড়া ফের জোড়া লাগে।