বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
শেষ আপডেট: 8th August 2024 15:49
দীর্ঘ সংস্কারপর্ব শেষে সেদিন নতুন করে সেজে ওঠা টাউন হল ফিতে কেটে আমজনতার জন্য উম্মুক্ত করে দিলেন জ্যোতি বসু। অনুষ্ঠান মঞ্চে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মেয়র প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় এবং সংস্ক়তি জগতের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষ। ভাষণে কথায় কথায় জ্যোতিবাবু বললেন, ‘এই যে আমাদের বুদ্ধদেব। ও বেশ শিল্প টিল্প নিয়ে আছে। সিনেমা, নাটক, গান, সাহিত্য এসবই ওঁর পছন্দ। শুনেছি, ওঁর বাসায় পা রাখার জায়গা নেই। চারধারে শুধু বই আর বই।’
কয়েক মাসের মাথায় শিল্প টিল্প নিয়ে আলোচনার জন্য ডাকা এক সভায় বিশেষ অতিথি বুদ্ধদেব। আছেন জ্যোতি বসুও। কিন্তু দু’জনের চোখ-মুখের প্রতিক্রিয়ায় বিস্তর ফারাক। জ্যোতিবাবু আর পাঁচটা দিনের মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু বুদ্ধদেব যেন গুটিয়ে আছেন। চোখ-মুখে চরম অস্বস্তি। বণিকসভার অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রথা মেনে অতিথির কপালে চন্দন, সিঁদুর আর চালের টিপ পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর শ্রোতার আসনেও শুধু শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা। এমন অভিজ্ঞতা এবং পরিবেশ সেই প্রথম। কারণ তাঁর এখানে আসার কথা ছিল না। অনুষ্ঠানের উদ্বোধক তথা প্রধান অতিথি জ্যোতি বসু হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেবকে।
ঘটনাটি বুদ্ধদেব মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বেশ কয়েক বছর আগের। বুদ্ধদেবই তাঁর উত্তরসূরী হবেন জেনে শিল্পমহলের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন পূর্বসূরী। তার আগে, ১৯৯৪-এর অক্টোবরে কেন্দ্রের উদার শিল্পনীতির আদলে রাজ্য সরকারের জন্য জ্যোতিবাবুর নয়া শিল্প প্রস্তাব, কলকাতায় কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজের শীর্ষ সম্মেলনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের আগমন ইত্যাদি পর্বে জ্যোতিবাবুর ছায়াসঙ্গী অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত। সেই সব দিনেই কোনও সিনেমা অথবা বইয়ে ডুবে ছিলেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত বোঝা যায়নি সেই জ্যোতিবাবুর ভাষায় নাটক, সিনেমা, নাচ, গান, সাহিত্যের মতো ‘শিল্প টিল্প’-তে মজে থাকা বুদ্ধদেবই রাজনীতির শেষ প্রান্তে এসে বাংলায় নয়া শিল্পায়ন, অর্থাৎ নতুন নতুন কলকারখানা তৈরির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন নিজের সযত্নে লালিত ভিন্ন ভাবমূর্তিকে খানিক বাজি রেখে। অবশ্য ১৯৯৬-এ কবিতা, সাহিত্যের সঙ্গে পুলিশ—এই দুই-কেও মিলিয়ে নিয়েছিলেন তথ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পুলিশ তথা স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ভার হাতে নিয়ে।
শিল্পের গুরুত্বটা কতটা বুঝেছিলেন বুদ্ধদেব? বাংলার শিল্প-অতীত মনে রাখলে বলতে হয়, একশো ভাগ সঠিক দিশা নিয়েই এগোচ্ছিলেন। বড় মাপের উৎপাদন শিল্প না থাকলে ছোট ও মাঝারি কলকারখানার দমবন্ধ হয়ে আসে। দৃষ্টান্ত হাওড়া, বারাকপুর শিল্পাঞ্চল। তাই সিঙ্গুরের উর্বর জমি যেমন টাটাদের দিয়েছিলেন, তেমনই পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমানে পাঁচটি বড়মাপের ইস্পাত কারখানা রুক্ষ জমি বেছে নিয়েছিলেন।
টাটাদের গাড়ি কারখানা ঘিরেই একশোটি ছোট অনুসারী শিল্প হওয়ার কথা ছিল। আবার নন্দীগ্রাম, নয়াচরের জমি সালিম গোষ্ঠীকে কেমিক্যাল হাব গড়তে দিতে চেয়েছিলেন বেশি চাকরি তৈরির লক্ষ্যে। প্রসার ঘটিয়েছেন একের পর এক শিল্প পার্ক, আইটি পার্কের। পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়ে, উপনগরী, বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে শিল্পের পরিকাঠামো বাড়াতেও নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন। বিধানচন্দ্র রায়ের পর বুদ্ধদেবের আগে বাংলায় এত বড় মাপের শিল্প পরিকল্পনা আর কোনও মুখ্যমন্ত্রীর সময়ে নেই। আর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে বাজি রেখেছিলেন সযত্নে লালিত দলীয় জমি নীতিকেই। বোঝাতে চেয়েছিলেন, কৃষকের সন্তান বলেই লাঙল ধরতে হবে, এটা কোনও অর্থনীতির ভাবনা হতে পারে না। আরও বোঝাতে চেয়েছিলেন, কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ক্রমে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। কাজ দেওয়া না গেলে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েরা বিপথে যাবে।
কথাগুলি জ্যোতিবাবুও বলতেন। মন্ত্রী মাত্রেই একথা বলবেন। কিন্তু বুদ্ধদেবকে হাতে ধরে শিল্পমহলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া জ্যোতিবাব বাম সরকারকে শিল্পায়নের নয়া পথে টেনে নিয়ে গেলেও তাঁর গতি ছিল কাঙ্খিত মাত্রার চাইতে কম। তাই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে বুদ্ধদেবের জমি অধিগ্রহণ কর্মসূচি ঘিরে যখন রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড় চলছে তখন কারও খেয়াল পড়েনি, তারও বছর দশ আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলপিতে নয়া বন্দর গড়তে বেসরকারি সংস্থাকে ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে দিতে বিজ্ঞপ্তি জারি পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জ্যোতি বসু গোড়াতেই বুঝেছিলেন, জমি নিতে গেলে রাজনীতির জমি হারাতে হবে। তাই ওপথে আর এগোননি। প্রাজ্ঞ রাজনীতিক বুঝেছিলেন, শিল্পায়নের জন্য চাষের জমি হাতছাড়া করার রাস্তায় সায় নেই দলের। আর দলকে দূরে রেখে কাজটা সহজও হবে না।
শিল্পায়নের রথ ছুটিয়ে বুদ্ধদেব এখানেই দলের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। তাই সিঙ্গুর কাণ্ডে একেবারে গোড়ায় টাটার অফিসারদের ঘিরে চাষিদের বিক্ষোভের খবর শুনে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘শুনেছি, টাটারা যে ওখানে জমি দেখতে যাবে, আমাদের পার্টির লোকজনকে তা আগাম জানানো হয়নি। আমাদের কৃষকসভার স্থানীয় নেতা বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলেন।’