বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
শেষ আপডেট: 8th August 2024 12:26
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'আঘাত সেজে পরশ তব, সেই তো পুরষ্কার'। রবীন্দ্র গানের এই লাইন যাঁর অতি প্রিয় তাঁর শাসনেই বামেদের কাজকর্মে রাজ্যের আমজনতা সব থেকে বেশি আঘাত পেয়েছিল। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের 'হান্ড্রেড ইয়ার অফ সলিচিউড' যাঁর ঠোঁটস্থ, ফেলিনি গোদার তারকোভস্কি-র একের পর ছবির দৃশ্যাবলী যিনি গড়গড় করে বিবরণ দিতে পারেন, তাঁর শাসনেই পুলিশ ও পার্টির ক্যাডারদের হাতে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। ছোট পত্র পত্রিকার একনিষ্ঠ দরদী যে মানুষ লিটল ম্যাগাজিন মেলার সূত্রপাত করেছেন তিনি আবার ভোটে হেরে যাওয়া স্বল্প শক্তির বিরোধীদের বিধানসভায় হেয় করে 'আমরা ২৩৫ ওরা ৩৫' বলে দম্ভ প্রকাশ করেছিলেন। বেকার যুবকদের কাজের স্বপ্ন দেখিয়ে রাজ্যে শিল্পায়ন করতে তিনি প্রাণপাত করেছিলেন। কিন্তু শিল্পের জন্য জমি হারা কৃষকদের ক্ষোভ অনুধাবন করতে পারেননি। রাজ্যে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের পতনের জন্য তিনি একমাত্র দায়ী, কখনই তাঁর দল সেই কথা বলেনি। কিন্তু তিনি নিজেই পরাজয়ের সমস্ত দায় মাথায় নিয়েই প্রবল অভিমানে ধীরে ধীরে দলের সমস্ত পদ ছেড়ে সেচ্ছা নির্বাসনে চলে গিয়েছেন।
অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি হওয়ার আগে শত অনুরোধেও পাম অ্যাভেনিউর দু কামরার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আর সক্রিয় রাজনীতির সামনের সারিতে ফেরেননি। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাই এক তুমুল বিতর্কিত অধ্যায়ের নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কারও কাছে তিনি প্রবল নিন্দিত, কারও কাছে তিনি ট্র্যাজিক নায়ক। কারও কাছে দাম্ভিক, কারও কাছে তিনি 'ভিশনারি'। কিন্তু ধ্রুপদী চলচ্চিত্র, নাটক, কবিতা চিত্রকলা থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা মূলক সাহিত্যের অঙ্গনে, রবীন্দ্র রচনা থেকে মার্কসবাদী উত্তর আধুনিক তত্ত্বে, মহাকরণের প্রশাসনের অলিন্দ থেকে ব্রিগেডের জনসমুদ্রে অবলীলায় বুদ্ধদেবের মতো বিচরণ করেছেন এমন রাজনীতিবিদ বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে দ্বিতীয় কেউ নেই। অবিচুয়ারির সংক্ষিপ্ত পরিসরে সুকান্ত ভট্টাচার্য ভ্রাতুষ্পুত্রের মুল্যায়ণ হয় না। ভবিষ্যতই হয়তো মুল্যায়ণ করবে এই কমিউনিস্ট নেতাকে।
অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশে ঠাকুরদা কৃষ্ণমোহন স্মৃতিতীর্থ সমাজে ব্রাহ্মন্যতন্ত্রের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতে বিখ্যাত 'পুরোহিত দর্পণ' সংকলন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, তাঁরই পৌত্র বুদ্ধদেব চাষি, খেতমজুরে ছেলে মেয়েকে চাকরি দিতে শিল্পায়নের স্বপ্ন ফেরি করেছিলেন। উঠেছিল সেই বিখ্যাত স্লোগান 'কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' । এই শিল্প করতে গিয়েই সিঙ্গুরের টাটার ন্যানো কারখানা, নন্দীগ্রামে পেট্রো কেমিক্যাল হাব, শালবনিতে ইস্পাত কারখানা, সালেমদের ডেকে আনা, ভিডিওকন, ইনফোসিস, উইপ্রোকে জমি দেওয়া সহ একগুচ্ছ প্রকল্পের জন্য একবগগা ভাবে লড়ে গিয়েছেন বুদ্ধদেব। সিঙ্গুর ছেড়ে টাটা চলে গিয়েছে, নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবেই রক্তগঙ্গা বয়েছে, শালবনিতেও দেশের বৃহত্তম ইস্পাত কারখানা হয়নি, সালেমদের বিনিয়োগ আসেনি। উল্টে শিল্পায়ন করতে গিয়ে জমি অধিগ্রহণের বিতর্কে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের ভিত নড়ে গিয়েছে। ঘরে বাইরে প্রশ্ন উঠেছে তার শিল্পায়নের পথ ও পদ্ধতি নিয়ে। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিল্পায়নের সেই বাবনা থেকে একচুলও সরেননি।
কী ছিল তাঁর 'ভিশন'? বহু চর্চিত সেই বিতর্ককে সংক্ষেপ করলে এই রকম দাঁড়ায়, ১৯৭৭ সালের ভূমি সংস্কারের ফলে রাজ্যে জমিহীনরা জমি পেয়েছে। কিন্তু কয়েক প্রজন্ম পরে সেই জোত পরিবারের মধ্যে বিভক্ত হয়ে আরও ছোট হয়ে। শুধু চাষের উপর নির্ভর করে আর কৃষক পরিবারের চলছে না। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে প্রতি বছর পাশ করে বেরোচ্ছে। কাজের খোঁজে এই ছেলে মেয়েরা হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কেরালায় ছুটছে। মেধাবীদের একাংশ বিদেশে যাচ্ছে। এই ছেলে মেয়েদের পশ্চিমবঙ্গেই কর্মসংস্থান করতে হলে শ্রম নিবিড় শিল্প চাই। গাড়ি, ইস্পাত কারখানা, ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে তথ্য প্রযুক্তি, সব ধরনের শিল্প চাই। যেখানে হাজার হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি হবে। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যেই সিঙ্গুরের তিন ফসলি জমিও রতন টাটার হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেনি বুদ্ধদেব। করোনাকালে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রাণ হাতে রাজ্যে ফেরার দৃশ্য দেখে রোগশয্যায় থাকা বুদ্ধদেব কী ভাবতেন, তিনিই জানেন। ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, অ্যাকাডেমেশিয়ানদের নির্মোহ গবেষণা হয়তো বলবে বুদ্ধদেবের এই 'ভিশন' সঠিক, না বেঠিক ছিল।
জ্যোতি বসুর দীর্ঘ বাম জমানায় শিল্পে খরা চলার পর ২০০৬ সাল থেকে বিদ্যুৎ গতিতে শিল্পায়ন করতে গিয়ে বামেদের চিরকালের বিশ্বস্ত সমর্থক গ্রামীণ কৃষিজীবী, সংখ্যালঘু, আদিবাসী মানুষ, শহুরে নিম্নবিত্ত জনতা যে পাশ থেকে সরে যাচ্ছে সেই বাস্তবতা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি, ঘরে-বাইরে এই অভিযোগ শুনতে হয়েছে বুদ্ধদেবকে। শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনের আপত্তি উড়িয়ে অনড় বুদ্ধদেব এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবেই মরিয়া হয়ে রতন টাটার স্বপ্নের ন্যানো কারখানা রাজ্যে ধরে রাখতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে বসতেই পিছপা হননি। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। বরং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনকে হাতিয়ার করেই বাম জমানার অবসান করেছেন তৃণমূল নেত্রী। প্রফুল্ল সেনের পর বুদ্ধদেব রাজ্যের দ্বিতীয় সিটিং মুখ্যমন্ত্রী যিনি ভোটে হেরেছেন। ২০১১-র পরিবর্তনের ভোটে যাদবপুরের মতো লাল দুর্গের সেই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি তিনি। অভিমানে যাদবপুরকে একপ্রকার ত্যাগ করেছিলেন।
অথচ ফ্ল্যাশ ব্যাকে বুদ্ধদেবের রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালে মনে হতেই পারে আদৌ কী রাজপাট চালানোর মানুষ ছিলেন তিনি। উত্তর কলকাতার বাগবাজারের বেড়ে ওঠা বুদ্ধদেব সিপিএম উঠে এসেছেন প্রমোদ দাশগুপ্তের অনুগামী হিসেব। কিন্তু ষাট ও সত্তরের ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির কিন্তু বুদ্ধদেব কখনই ছিলেন না। জঙ্গি ছাত্র আন্দোলনের সামনে থাকার পরিবর্তে প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী বুদ্ধদেব বরং কফি হাউসে, বইপাড়ায়, কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, চিত্র শিল্পীদের মধ্যে তর্ক বিতর্কে বেশি জড়িয়ে ছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র নিয়ে বামেদের রক্ষণশীল অংশ সমালোচনায় মুখর হলে সেই চলচ্চিত্রকারের হয়ে কলম ধরেছেন। ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলন, লিটল ম্যাগাজিনের পরীক্ষা নিরীক্ষা, উৎপল দত্ত শম্ভু মিত্রদের নাটকের পরীক্ষা নিরীক্ষার একনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন তিনি। নিখাদ সংস্কৃতি মনস্কতার কারণেই বামফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী হয়ে প্রবেশ ঘটেছিল বুদ্ধদেবের। সেই তুলনায় একই প্রজন্মের শ্যামল অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন দফতর পেয়েছিলেন।
আসলে কমিউনিস্ট হলেও আবেগের রাশ হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না বুদ্ধদেব। এই কারণে মত পার্থক্যর জেরে দুম করে জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল তিনি। অভিমানে লিখে ফেলেছেন ' দুঃসময়' নাটক। আবার বুদ্ধদেব আবেগে চলেন বলেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিট তাঁর বিরুদ্ধে কড়া কোনও শাস্তির পথে যায়নি। তাই রাজপাট চালানোর চেয়ে নন্দনের লাইব্রেরিতে কিংবা নন্দন-৩ এর প্রেক্ষাগৃহে ফেলিনি, গোদার, ত্রুফো, আইজেনসটাইনের জগতে থাকতে হয়তো তিনি বেশি ভালোবাসতেন। নন্দন নির্মাণ ও চলচ্চিত্র উৎসবের সূচনার নেপথ্যে বুদ্ধদেবের অবদান সব থেকে বেশি। উল্লেখ্য, নন্দনই কিন্তু রাজ্যের প্রথম মাল্টি প্লেকস। যদিও সেই সময় মাল্টি প্লেকস শব্দটি এ দেশে আসেনি। এই নিখাদ সংস্কৃতি মনস্কতার কারণেই তথ্য সংস্কৃতি দফতর থেকে ২০০০ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার মুখে তিনি যখন জ্যোতি বসুর হাত থেকে ব্যাটন তুলে নিলেন তখনও মহাকরণের কাজের শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক ঘণ্টা নন্দনে কাটিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে যেতেন পাম অ্যাভিনিউর বাসিন্দা।
২০১১ সালে বুদ্ধদেব বাম দুর্গ রক্ষা করতে পারেননি। কিন্তু ২০০১-এ কেশপুর, গড়বেতা, নানুর, গোঘাট, খানাকুলের সেই রক্তক্ষয়ী আবহে বুদ্ধদেবকে স্বচ্ছ ও উদ্যোগী ভাবমূর্তির প্রতীক হিসেবে প্রজেক্ট করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোকাবিলা করে বামেরা ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল। সেই নির্বাচনে বামেদের বিদায় ঘণ্টা বাজবে এই ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে বাম সরকারে ও দলের অন্দরে নিজের জমি শক্ত করতে পেরেছিলেন একদা বিদ্রোহী বুদ্ধদেব। কিন্তু প্রশাসক হিসেবে যে দৃড়তা বজায় রাখা প্রয়োজন সেই দৃড়তা তিনি ধরে রাখতে পারেনিনি বলেই বহু বাম নেতা মনে করেন। তাই তসলিমা নাসরিনকে ঘিরে বিতর্কে হিংসা, রিজওয়ানুর বিতর্ক, সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নেতাই পর্বে দৃড়তার বদলে দোলাচলে পড়েছেন তিনি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে মমতাকে দিনের পর দিন অবস্থান করতে দিয়েছেন। ধীরে ধীরে দলীয় সংগঠনের থেকে পুলিশ প্রশাসনের উপরে তাঁর নির্ভরতা বেড়েছে। বুদ্ধদেবের এই মানুষ চিনতে ভুলের মাশুল দলকে দিতে হয়েছে। নন্দনের বৃত্তে একদল চাটুকার তাঁর চারপাশে হাজির হয়েছিল এই অভিযোগ উঠেছে।
আসলে প্রমোদ দাশগুপ্তের হাতে তৈরি হলেও বুদ্ধদেব কোনও দিনই দক্ষ সংগঠক ছিলেন না। ছিলেন না, জ্যোতি বসুর মত 'মাস লিডার'ও। জ্যোতি বসুর দীর্ঘ জমানায় একটি বড় অংশ জুড়েই পিছনের সারিতে ছিলেন তিনি। বসুর হাত থেকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের ব্যাটন হাতে নেওয়ার পরও দলের সংগঠনের উপর নিয়ন্ত্রণ কখনই তৈরি হয়নি। ধর্মঘটের ইস্যুতে কিংবা জমি অধিগ্রহণের ইস্যুতে সিটু ও কৃষক সভার সঙ্গে তাঁর বনিবনা হয়নি। জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরি, রাজ্যে ভূমি সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের সঙ্গে যে ভাবে দল ও গণসংগঠনকে একসুরে ময়দানে নামাতে পেরেছিলেন, ২০০৬ সালের শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বুদ্ধদেব দল ও গণসংগঠনকে সেই ভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। সিপিএম তার দলিলেও এই ভুল কবুল করেছে। দলের উপর সেই নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কিংবা লালগড় আন্দোলনকে তিনি প্রশাসনিক ভাবে মোকাবিলা করতে গিয়েছিলেন। প্রশাসনের উপর তাঁর বাড়তি নির্ভরতার মাশুল গুণতে হয়েছে বামফ্রন্টকে। বাম শরিক নেতৃত্বর সঙ্গে তাঁর বনিবনা হতো না।
ফলে ক্ষিতি গোস্বামী থেকে নন্দগোপাল ভট্টাচার্য প্রমুখ শরিক নেতৃত্ব প্রকাশ্যে সমালোচনা করতেন। তাই প্রশাসক বুদ্ধদেবের সাফল্যের থেকে ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ হলেও তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও দুর্নীতির অভিযোগ তাঁর অতি বড় বিরোধী তুলতে পারেনি। দাম্ভিক, অহংকারী, নন্দনে তাঁর চারপাশে চাটুকারদের বৃত্ত তৈরি হওয়ার মতো অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস কারও হয়নি। পাম অ্যাভেনিউতে একতলায় এসি-হীন দু কামরার যে ফ্ল্যাটে তিনি থেকেছেন ভারতের খুব কম মুখ্যমন্ত্রী এই ভাবে জীবন কাটিয়েছেন। বিদ্যুতের বিল বেড়ে যাবে এই ভয়ে এসি লাগাননি তিনি। মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় সাধারণ দোকান থেকে ঘুগনি পাউরুটি এনে টিফিন সারতেন। বিলাসিতা বলতে সিগারেট খাওয়া। এই চেইন স্মোকার হওয়ার জেরেই সিওপিডিতে কাবু হয়ে পড়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে গৃহবন্দি হওয়ার আগে বুদ্ধদেব যে দিশা দেখাতে পেরেছিলেন সেই পথে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হাঁটছে। ২০১৬ সালে রাজ্যে বাম ও কংগ্রেস জোট সম্ভব হতো না বুদ্ধদেব না থাকলে।
জোটকে বিশ্বাসযোগ্য করতে পার্ক সার্কাসে রাহুল গান্ধীর সঙ্গে যৌথ সভাও করেছিলেন তিনি। রাজ্য তৃণমূল ও বিজেপির মোকাবিলা করতে কংগ্রেস সহ ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তির যে জোট প্রয়োজন সেই লাইনে কলকাতায় বসেই সওয়াল করেছেন তিনি। বুদ্ধদেব ও ভিএস অচ্যুতানন্দন যৌথ হস্তক্ষেপেই জোটপন্থী সীতারাম ইয়েচুরি সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক হতে পেরেছিলেন। ২০১৬ সালের নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর প্রকাশ কারাট শিবির আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের জোটের লাইন খারিজ করলেও হায়দরাবাদ পার্টি কংগ্রেসে সেই লাইনে শিলমোহর পড়ে বুদ্ধদেব নেপথ্যে থাকায়। রাজ্য সিপিএমের ছোট্ট একটি অংশ এই জোট নিয়ে সংশয়ী থাকলেও সংখ্যা গরিষ্ঠ নেতৃত্ব যে জোটের লাইনে এসেছেন তা বুদ্ধদেবের প্রভাবেই। যদিও ততদিন সেচ্ছা নির্বাসনে চলে গিয়েছেন তিনি। এই ভাবে সেচ্ছায় দলের সমস্ত পদ, ক্ষমতা, ছেড়ে দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।
জীবনের শেষ পর্বে চোখে ভালো দেখতে পেতেন না বুদ্ধদেব। খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হতো। সেই অক্ষমতার মধ্যে একাধিক বই লিখেছেন। প্রতিটি বই পুজোর সময় ও বই মেলায় সিপিএমের স্টল থেকে হককেকের মতো বিক্রি হয়েছে। এই বইগুলোর অনেক কথাই খোলামেলা আলোচনা করেছেন তিনি। প্রশাসক বুদ্ধদেবের ব্যর্থতার তালিকা দীর্ঘ ঠিকই। কিন্তু তার মধ্যেই ইতিহাস বলবে সল্টলেকের পর কলকাতার পাশে দ্বিতীয় উপনগরী নিউটাউন তাঁর জমানায় হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো সহ একাধিক সংস্থা এসেছে। মণিকাঞ্চন পার্ক হয়েছে। বানতলায় লেদার কমপ্লেক্স বেড়েছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থান হয়েছে। আইটিসি সহ একাধিক বড় সংস্থার বিনিয়োগ হয়েছে। কলকাতায় একের পর এক ফ্লাই ওভার হয়েছে। লোডশেডিং শব্দটি রাজ্য থেকে চলে গিয়েছে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, নাট্য মেলা, যাত্রা উৎসব, লিটল ম্যাগাজিন মেলা সহ অনেক সংস্কৃতি কর্মকান্ডের রূপকার বহু নিন্দিত এই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
বিপক্ষের কঠোর সমালোচনা শুনে এক সন্ধ্যায় নন্দনের সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, 'আঘাত সেজে পরশ তব সেই তো উপহার।'