শেষ আপডেট: 8th August 2024 12:37
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কমিউনিস্ট ও চেতনাশীল নেতা-নেত্রীরা চিরকালই লেখালেখি করেন। চে গ্যুভেরা থেকে গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ কিংবা ম্যাক্সিম গোর্কি অথবা মায়কোভস্কি। এর মধ্যে দেশীয় নেতানেত্রীরাও চিরকাল কলম ধরেছেন হয় বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিয়ে, নয়তো জনজাগরণের স্বার্থে প্রচারযন্ত্র হিসেবে। কিন্তু, তাঁদের সকলের মধ্যে কমিউনিস্ট হয়েও চে-র মতো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মধ্যে অন্তঃসলিলা ছিল এক কবি। তাই লেখার মাধুর্য ও স্বাদ ছিল অন্য জাতের। শুধু লেখালেখি নয়, তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্ত। যে মার্কসবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি হিসেবে দূরে ঠেলে রেখেছিলেন, তাঁদের কাছ রবীন্দ্রনাথকে ছিনিয়ে জনগণের কবি করে তোলার কাজ যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই মানুষটিও ছিলেন অগ্রগণ্য। তাই তাঁর কলমে সর্বদা সর্বহারা শ্রেণির সঙ্গে কাকা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো এক স্বভাব রোমান্টিক মানুষ ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াত।
যদি কোনও লেখকের লেখার প্রিয় তিনটি জগৎ হয় নাটক-প্রবন্ধ ও অনুবাদ সাহিত্য, তাহলে সাহিত্য সমালোচকরা তাঁকে সাধারণত বাড়তি সমীহের চোখে দেখেন, এমনটাই প্রচলিত রীতি! কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের প্রতি পক্ষপাত ও বিদ্বেষ আজ এমন পর্যায়ে যে তাঁদের সাহিত্য প্রতিভার যথার্থ কদর তাঁরা পান না! তাই জীবদ্দশায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পড়ার থেকে তাঁর লেখক-কৃতী নিয়ে সমালোচনার যূপকাষ্ঠে বারবার বলি দেওয়া হয়েছে। তাতেও থেমে থাকেননি সিগারেটের শৃঙ্খলে বাঁধা এই কমিউনিস্ট নেতা। আদর্শ কমিউনিস্টের মতোই সন্ন্যাসী থেকে যাবতীয় নিন্দা, উপহাসকে বৈরাগ্যের দৃষ্টিতে দেখে গিয়েছেন।
নিজের সাহিত্যচর্চা, সংস্কৃতিমনস্কতার জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলা বিভাগের এই প্রাক্তনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে কম বিদ্রুপ হজম করতে হয়নি। এমনকী একদা জেলবন্দি এক সাংবাদিক তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পারিবারিক পরিচয় টেনে 'জনৈক আধা কবি'র ভ্রাতুষ্পুত্র বলে আক্রমণ করতেও দ্বিধা করেননি!
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর ছাত্র-জীবন থেকেই সাহিত্যচর্চায় নিবিড়ভাবে যুক্ত। শুধু লেখক নন, তাঁর পাঠাভ্যাস গবেষকের মতো বিস্তৃত। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, রবীন্দ্রনাথ, মায়কোভস্কি, কামু, কাফকা, মার্কেজের বই তাঁর পড়ার টেবিলে থাকত। তাঁর নাটক ও চলচ্চিত্রপ্রেম যে কোন শিক্ষিত সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির মতোই। শরীর যতদিন সুস্থ ছিল কলকাতা শহরে ভালো নাটক, ভালো সিনেমা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাধারণত না দেখে থাকতেন না। অতি সাধারণের মতোই অ্যাকাডেমি, নন্দনে নাটক-সিনেমা দেখতে আসা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পাওয়া যেত।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম লেখালেখির জগতে উঠে আসে ১৯৯৩ সালে ‘দুঃসময়’ নাটক থেকে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবতার জয় ঘোষণা এই নাটকের বিষয়বস্তু। মোট ছয়টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটকের সংকলন এই গ্রন্থ। দুঃসময় ছাড়া অন্য কোনও নাটক সেভাবে মঞ্চস্থ না হলেও, ‘ইতিহাসের বিচার’ ও ‘রাজধর্ম’ দুটি নাটকে যথাক্রমে ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে ফিরে দেখতে দেখতে পৃথিবীতে মৌলবাদ এবং স্বৈরতন্ত্রের পুনরুত্থানের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে।
পাশাপাশি ‘রাজধর্ম’ নাটকে উনিশ শতকে আমাদের দেশে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসী চেহারা দেখানো হয়েছে। দুঃসময় নাটকে যেমন মানবতা ও প্রেমের জয় দেখানো হয়েছিল, এই দুটি নাটকে তেমন নয়। ইতিহাসের বিচার ও রাজধর্মে পরাক্রান্ত শাসকের হাতে প্রতিবাদীর কণ্ঠ নিষ্পেষিত হয়, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মুক্তির স্বপ্ন ও স্বাধীনতার আদর্শ আপস করে না। আসলে ধ্রুপদী সাহিত্যের পাঠক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একজন মার্কসবাদী হিসাবে শ্রেণিদ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রমকে কখনও অস্বীকার করেননি।
ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রতি তিনি বিশ্বস্ত থেকেছেন পরবর্তী সময়ে লেখা নাটক ‘পোকা’ নিয়েও বহু আলোচনা হয়েছিল। তবে এটি তাঁর মৌলিক রচনা নয়। ফ্রানৎজ কাফকা রচিত ‘মেটামরফোসিস’ অবলম্বনে লেখা! একই ভাবে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাস অনুবাদ করেছেন ‘বিপন্ন জাহাজের নাবিক’, যা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পায়।
তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আলোচনাগ্রন্থ ‘পুড়ে যায় জীবন নশ্বর’ (১৯৯৯ সালে প্রকাশিত)। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ও ছোট গল্প নিয়ে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে অসাধারণ বিশ্লেষণ করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রবন্ধের লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর দৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম দশ বছর ও শেষ দশ বছর নিয়ে দুই খণ্ডে 'ফিরে দেখা' নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা দেশকালের ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয়ে আরও দুটি গ্রন্থ যথাক্রমে 'নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু' এবং ‘স্বর্গের নীচে মহাবিশৃঙ্খলা’ (চিনের পরিস্থিতি নিয়ে লেখা) বিপুল জনপ্রিয় হয়েছে।
তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেই নির্দ্বিধায় লিখতে পারেন, সোভিয়েত ইউনিয়নে (সাবেক) সাহিত্যে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ফতোয়া জারি কি সঠিক ছিল? কেন দস্তয়ভস্কি কোনোদিনও প্রাপ্য সম্মান পেলেন না, পাস্তারন্যাক কেন নির্বাসিত হলেন স্বদেশভূমিতে? (ফিরে দেখা প্রথম খণ্ড পৃঃ ৩৪)। ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিমবঙ্গে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী থাকার সময় গত শতাব্দীর আটের দশকে সমরেশ বসুর একটি উপন্যাস নিষিদ্ধ করার সুপারিশ এলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তা গ্রাহ্য করেননি।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখা কিছু বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
বিম্পন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প: কলম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখা বইয়ের অনুবাদ। ১৯৫৫ সালে কলম্বিয়ান নৌবাহিনীর একটি জাহাজ 'ক্যালাডাস' ক্যারিবিয়ান সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা রাজ্যের একটি বন্দর শহর মোবাইল থেকে জাহাজটি শুরু হয়েছিল। গন্তব্য ছিল কার্টেজেনা, কলম্বিয়ার বন্দর। জাহাজটি নিরাপদে কার্টেজেনা বন্দরে পৌঁছেছিল কিন্তু মাত্র একজন বেঁচেছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য 'দ্য স্টোরি অফ আ শিপরেকেড সেলর' বইটি অনুবাদ করেছেন।
দুঃসময়: দ্য ব্যাড টাইমসের অনুবাদ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাটকটি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর হিন্দু ও মুসলমানে মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে।
চিলিতে গোপনে: কলম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অনুবাদকৃত কাজ। চিলির আধুনিক ইতিহাসে একটি অন্ধকার দিন ছিল। জেনারেল পিনোচেটের সামরিক বাহিনী সালভাদর আলেন্দের বামপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে একটি সহিংস অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে। হাজার হাজার মানুষকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। আক্রমণগুলি কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী এবং বামপন্থীদের উপর কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। অভ্যুত্থানের পরপরই চিলির বিখ্যাত পরিচালক মিগুয়েল লিটিনকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়। পরে ঘোষিত অবাঞ্ছিত ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১২ বছর পরে তিনি সামরিক শাসনের ধ্বংসলীলায় তাঁর দেশ এবং এর জনগণকে চিত্রিত করার জন্য একটি মিথ্যা পরিচয়ের ছদ্মবেশে চিলিতে প্রবেশ করেন। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিখ্যাত ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের কাছে দুঃখজনক গল্পটি বর্ণনা করেছিলেন। মার্কেজ তার 'ক্ল্যান্ডেস্টাইন ইন চিলি' বইতে অভিযানটি লিপিবদ্ধ করেছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ' ক্ল্যান্ডেস্টাইন ইন চিলি' বইটি অনুবাদ করেন।
ফিরে দেখা (প্রথম পর্ব): বইটি পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের (১৯৭৭-১৯৮২) সাল পর্যন্ত সময়ের এক লেখ্য দলিল।
ফিরে দেখা (দ্বিতীয় পর্ব): এটিও পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের (২০০১-২০১১) অগ্রবর্তীকালের একটি সময়নিষ্ঠ রচনা। কমিউনিস্ট নেতার একটি খোলামেলা এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণ এতে মেলে। যিনি এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মতো বিতর্কিত বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন এবং উন্নয়নমূলক লক্ষ্য এবং কৃতিত্বের দিকে মনোনিবেশ করেন।
নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু বইতে ১৪টি অধ্যায় রয়েছে। যার মধ্যে মুখবন্ধ ও পরিশিষ্ট রয়েছে। এই বইতে হিটলারের উত্থান থেকে হিটলারের শেষ দিন পর্যন্ত ইতিহাস বিবৃত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে ফুয়েরার, আত্মরক্ষার জন্য রাশিয়ার সংগ্রাম, জার্মানি ও ইতালির পতন, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে।