শেষ আপডেট: 8th April 2023 08:37
শুক্রবার কুণাল ঘোষের সাংবাদিক বৈঠকের পর কলকাতার মহানাগরিক ফিরহাদ হাকিমের ( Bobby Hakim) কিছুটা বেইজ্জতিই হয়েছে। তার পর রাতে ঢোঁক গিলে বর্ধিত পার্কিং ফি প্রত্যাহার করে নিয়েছে পুরসভা।
ফিরহাদ হাকিম মানে তৃণমূলের ববি দলের বহু পুরনো নেতা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) উপর আস্থা রেখে যাঁরা কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ববি তাঁদেরই একজন। এখন বয়স হয়েছে। প্রায় ষাট বছর। গত ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে মন্ত্রী পদে থাকার কারণে প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদাও বেড়েছে। তাই কুণালকে দিয়ে ওভাবে সাংবাদিক বৈঠক করানোয় ববির হয়তো অভিমান হয়েছে। অপদস্থও বোধ করেছেন।
কিন্তু এ তো ববিরই ভুল। দেবাংশু-জয়ারা করলে তবু নয় বোঝা যেত। পুরনো অনেক ঘটনাই নতুন প্রজন্মের নেতারা জানেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক দর্শন কী তা ওঁদের হয়তো পরতে পরতে বুঝে নিতে আরও সময় লাগবে। কিন্তু ববির কেন মনে পড়ল না? পার্কিং ফি বাড়ানোর আগে কেন দিদিকে ছুঁয়ে নিলেন না ববি?
কেন দিদিকে ছুঁয়ে নেবেন?
এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হলে একটু পিছনে হাঁটতে হবে। তখন ২০১২ সাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ায় রেলমন্ত্রী হয়েছেন দীনেশ ত্রিবেদী। তার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছু না জানিয়েই রেল বাজেটে যাত্রী ভাড়া আচমকাই বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেন দীনেশ। তিনি হঠাৎ সংস্কারপন্থী হয়ে উঠেছিলেন, নাকি আহমেদ পটেলরা তাঁকে দম দিয়েছিলেন কে জানে? রেলমন্ত্রী হিসাবে মমতা যে কখনওই ভাড়া বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন না, উল্টে গরিব মানুষকে কম ভাড়ায় রেলযাত্রার সুবিধা করে দিতে ‘ইজ্জত কার্ডের’ বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন, সেটা বেমালুম যেন ভুলে গিয়েছিলেন দীনেশ। বাকিটা ইতিহাস। ক্ষুব্ধ মমতা কালক্ষেপ না করে রেলমন্ত্রক থেকে সরান দীনেশকে। তারপর মুকুল রায়কে রেলমন্ত্রী করে ফের ভাড়া কমিয়ে দেন রেলের।
এতো গেল দিল্লির কথা। পুরসভাতেও এমন নজির রয়েছে। ইউপিএ জমানায় তৃণমূল যখন শরিক দল তখন প্রণব মুখোপাধ্যায়রা বারবার চাপ দিচ্ছিলেন বাংলায় পুর নিগমগুলিতে জল কর চালু হোক। কারণ, জওহরলাল নেহরু আর্বান রিনিউয়াল মিশনের আওতায় কেন্দ্রের অনুদান পেতে গেলে সেটা পূর্বশর্ত। যাতে পুরসভাগুলো আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে। কিন্তু তা কখনওই হতে দেননি মমতা।
তারও আগের ঘটনা রয়েছে। ২০০০ সালে তৃণমূল কলকাতা পুরসভা দখলের পর মেয়র হয়েছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সাম্প্রতিক কালে কলকাতা পুরসভায় যাঁরা মেয়র হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে দূরদর্শী ও সুপ্রশাসক ছিলেন সুব্রতবাবু। কলকাতা পুরসভায় ঘুঘুর বাসা ভেঙেছিলেন তিনিই। এহেন সুব্রতবাবু একবার ধর্মতলা এলাকায় হকার উচ্ছেদে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে কথা জানতেন না। সুব্রতবাবু এ ব্যাপারে মমতার সঙ্গে আগাম কোনও আলোচনাও করেননি। বিকেল ৩টে নাগাদ যখন বুলডোজার ধর্মতলায় পৌঁছে যায়, তখন হঠাৎই কালীঘাট থেকে ফোন পান সুব্রত। মমতা তাঁর কাছে জানতে চান, তাঁকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন? এভাবে গরিব মানুষের পেটে আঘাত করা যাবে না। দেখা যায়, উচ্ছেদ তো দূর, আধ ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে যায় সব বুলডোজার।
এটা ঠিক যে, কলকাতা পুরসভার রাজস্ব আদায় বাড়ানো দরকার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক, বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠানও মনে করে আর্বান লোকাল বডি বা শহুরে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। নইলে সরকার যে নাগরিক পরিকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে, তার দীর্ঘমেয়াদি রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও উন্নত পরিষেবা দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভবত সেই কারণেই কলকাতায় পার্কিং ফি বাড়াতে চেয়েছিল পুরসভা। কিন্তু ববি হাকিমের মনে পড়া উচিত ছিল, যে পুরসভায় জল কর বসাতে দেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানে দুম করে কয়েকগুণ পার্কিং বাড়িয়ে দেওয়া ঝুঁকির বইকি। আসলে প্রশাসনিক ভাবে যা প্রুডেন্ট তা রাজনৈতিক ভাবে সব সময়ে সঠিক হয় না। আমলারা যত সহজে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলে দিতে পারেন, একজন রাজনীতিকের পক্ষে ব্যাপারটা মোটেই তত সহজ নয়। সমাজের সব স্তরের, সব শ্রেণির মানুষের কথা তাঁকে মাথায় রাখতে হয়।
ব্যাপারটা শুধু তা নয়, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অনেকেই বহু সময়ে তাঁর প্রকৃত ওজন বুঝতে পারেন না। মন্ত্রিসভা বা সংগঠনে কোনও দায়িত্ব পেয়ে ভাবতে শুরু করেন, তিনি বোধহয় খুবই অপরিহার্য। তিনি যোগ্য এবং মেধাসম্পন্ন। আসলে তিনি যে সূর্যের আলোয় আলোকিত, তিনি যে দয়ার দান নিয়ে রয়েছেন, তাঁর যে ভূরি ভূরি বিকল্প বাইরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তা মাথায় থাকে না। সম্ভবত তাই ববি হাকিমরা ভুল করে বসেন।
এর পর কলকাতা পুরসভার মেয়র হিসাবে ববি হাকিমের আর কোনও মর্যাদা থাকল? আর কোনও কর্তৃত্বও রইল কি? পুরসভার অফিসার বা আমলাদের কী ধারণা হল? মহানাগরিক কোনও বড় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাঁরাই প্রশ্ন তুলতে পারেন, স্যার আপনি ম্যাডামকে ছুঁয়ে নিয়েছেন তো?
কলকাতায় পার্কিং ফি পুরনো হারেই, মমতার নির্দেশের পর ঢোঁক গিলল ববির কর্পোরেশন