শেষ আপডেট: 18th February 2025 17:10
শুভেন্দু ঘোষ
এরা কারা!
এরা কি আমাদের লোক?
মঙ্গলবার বিধানসভা চত্বরে 'গর্বিত হিন্দু' বিজেপি বিধায়করা যে গেরুয়া পাগড়ি পরে ধরনা দিলেন, তাঁরা আদৌ বাঙালি তো! দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছিল, বুঝি মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাতের কোনও বিধানসভার ছবি দেখছি। এঁদের কেউ আদিবাসী, সাঁওতাল সমাজের মাথার আচ্ছাদন পরেননি। তাঁদের কেউ কোচবিহারের মাঠে ধানচাষ করা কৃষকের টোকা পরেননি, ঝড়জল, রোদ উপেক্ষা করে নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের গামছা মাথায় দেননি। ভোটে জেতা জনপ্রতিনিধি কীভাবে বুঝতে পান যে, তিনি একটিও মুসলিম ভোট পাননি! তাহলে কোথায় গেল তাঁদের কারও মাথায় একটি অন্তত প্রতীকী ফেজ? যদিও তাঁদের লড়াই কোনও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয় বলে জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু, তাহলে হঠাৎ কেন বঙ্গ বিধায়কদের এমন যাত্রাপালার ঢঙে গেরুয়া পাগড়ি পরে ধরনা! যেখানে কোনটা আমার এলাকার বিধায়ক, কোনটা আপনার এলাকার, তাই চেনা দায় হয়ে পড়বে।
বঙ্গ সমাজে আমাদের অধিকাংশ লোকের কাছে প্রথম পাগড়ি পরা মানুষ হলেন রামমোহন রায়, তারপর রয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নব্যবাবু সমাজেও পাগড়ি পরতেন কেউ কেউ বাবু। পাগড়িতে নাম করেছিলেন তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু, তাঁর পাগড়ি পরার স্টাইলও ছিল নিজস্ব অন্তত অবাঙালি সুলভ নয়। অতীতে বাঙালি বাবুদের পাগড়িতে মুসলিম অনুকরণ না থাকলেও পুরোদস্তুর অবাঙালি ধাঁচও ছিল না। সোজা হিসেবে মাথায় গামছা বাঁধার যে প্রাথমিক রীতিটি প্রয়োগ করা হয়, তাকেই সুন্দর মখমলি কাপড় (অর্থবান হিসেবে পাগড়ির মূল্যও পৃথক ছিল) দিয়ে পাগড়ি বাঁধা হতো শক্ত একটি কাঠামোর (টুপি সদৃশ) উপর। সে কারণে অনেকে রামমোহনের টুপিও বলে থাকেন।
বিবেকানন্দ ১৮৯১ সালে রাজস্থানের খেতরির মহারাজা অজিত সিংয়ের অনুরোধে প্রথম এই পাগড়ি পরেন। সেই বেশেই শিকাগোয় ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন স্বামীজি। স্বামীজির দেওয়া সেই পাগড়ি আজও সংরক্ষিত রয়েছে হাওড়ার নবগোপাল ভবনে। সেখানে গিয়ে বিবেকানন্দ মুরগির মাংস খেয়েছিলেন, প্রতিউপহার হিসেবে বাড়ির গিন্নিকে দিয়েছিলেন সেই পাগড়ি। এসব কথা যে কোনও বাঙালিমাত্রেই জানেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও গুপি-বাঘার পাগড়ির ধাঁচে অবাঙালি সুলভ ব্যাপার আছে। কারণ, তারা তখন বাংলা ছেড়ে ভিনরাজ্যে বেড়াতে যাওয়া অতিথি। হীরকরাজা যে পাগড়ি পরেছিলেন, তার মধ্যে ইসলামি শিল্প না থাকলেও ভারতীয়ত্ব ছিল পুরোদমে, তার সঙ্গে ছিল ছন্দোবদ্ধ বিশুদ্ধ ও চলিত বাংলার অদ্ভুত মিশেল। তাই একটি সময়ের জন্যও হীরকের ভগবান রাজাকে অবাঙালি বলে মনে হয়নি।
কিন্তু, এদিন যে বিধানসভার বাইরে সিঁড়িতে বসে থাকা মাথাগুলিকে গেরুয়া পাগড়ি পরে দেখা গেল, তাঁদের তো বাঙালি বলে মনে হল না। সাম্প্রদায়িক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে একটি 'উগ্র' সম্প্রদায়ের রাজকীয়, বৈবাহিক রীতি, অহংকার, উচ্চবর্ণের আভিজাত্যের প্রতীক পাগড়ি পরা বিধায়করা প্রতিবাদ করতে গিয়ে একক স্বাজাত্যবোধকে তুলে ধরলেন না? আর তা করতে গিয়ে অজ্ঞাতে হোক আর সজ্ঞাতে হিন্দু-মুসলমান ভোটের থালা আলাদা করে ফেললেন না!
কারণ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তো এই পাগড়ির সঙ্গে পরিচিত নন। ইদানীং রাজ্যে হিন্দিভাষীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বরাতির শোভাযাত্রায় গোলাপি পাগড়ি পরাদের দেখে দেখে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে জাত-পরিচয়। এখানে গোলাপির জায়গা নিয়েছে গেরুয়া, যা আর এখন সন্ন্যাসধর্মের পরিচয়বাহী নয়, বিশেষ একটি ধর্মের উগ্রগন্ধ বয়ে বেড়ায়। দ্বিতীয়ত, রাজ্য বিধানসভায় যাঁরা পা রেখেছিলেন অতীতে তাঁদের অনেকেরই পরনে ছিল ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে শাল বা চাদর। বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, অজয় মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিনয় চৌধুরী, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, সোমেন দত্ত, মায় হাসিম আবদুল হালিমও ঢোলা পাঞ্জাবির সঙ্গে বাঙালি পাজামা নয়তো ধুতি পরতেন। বিধানচন্দ্র ও সিদ্ধার্থশঙ্করকে মাঝেমধ্যে জামা ও টি-শার্টে দেখা গেলেও জ্যোতিবাবু কোনওদিন ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া অন্য কিছু পরে শীতকালে গলাবন্ধ কোট-প্যান্ট পরতেন অবশ্য। তবে বেশিরভাগ সময় দিল্লি বা বিদেশ যাত্রাকালে।
সে কারণে বাঙালিবাবু বলতে যে ছবিটা সামনে ধরা পড়ে তাতে ব্রহ্মতালুর কাছে পাগড়ির গাঁদাফুল ফুটে থাকে না। দেখলেই মনে হয় 'বর্গি এল দেশে'। ফলে এটা যদি সেই ছড়ারই সূত্রপাত হয়, তাহলে বাকি রইল, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবে কীসে, এবং সবশেষে খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল। বাঙালি পুরোপুরি বাঙালিত্ব হারাল।