বিভূতিভূষণ ও 'পথের পাঁচালী'
শেষ আপডেট: 6th February 2025 18:00
রূপক মিশ্র
১৯২৫ সাল। বসন্তের প্রথম দিন। অথচ সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বেলা গড়াতেই বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। আজমাবাদ কাছারির ছোট টেবিলে দিস্তে দিস্তে কাগজের স্তূপ। ঘনঘোর বর্ষায় উপন্যাস লিখে চলেছেন এক ‘বাঙালি বাবু’। পেশায় ‘এস্টেট ম্যানেজার’। কীসের ঘোরে, কীসের টানে এত কথা, এত শব্দের স্রোত ভেসে আসছে, তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না। কোনও এক মন্ত্রশক্তি যেন বয়ে আনছে ফেলে আসা জীবনের গল্প, হারানো স্বজনের প্রিয়মুখ। কিছু স্মৃতি, কিছু শ্রুতি। কিছু মনে গাঁথা, কিছু কানে শোনা। ‘মৃত মাধুরীর’ সেই সব ‘কণা’ই যেন ‘স্মৃতিপিপীলিকা’ ‘পুঞ্জিত’ করে চলেছে… অক্লেশে, অনায়াসে।
কখনও মুহুরি গোষ্ঠবাবু লণ্ঠন হাতে হিসেব বোঝাচ্ছেন, ধাওতাল সাহু উত্তর বিহারের বন্যা আর জলে ডুবে যাওয়া মাকাইয়ের খেত নিয়ে বিলাপ গাইছে, যুগলপ্রসাদ বিনা ভূমিকায় অনতিদূরের বটেশ্বরনাথ পাহাড়ের নীল দৃশ্য, মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের দিগন্তলীন ‘আরণ্যক’ সৌন্দর্য দেহাতি সুরে বর্ণনা করে যাচ্ছে… সেসব শুনতে শুনতে জানলার বাইরে নজরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটায় দুলে দুলে ওঠা বেলফুল আর স্মৃতিতে ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে চলেছে বসন্ত-বিকেলে সোঁদালি ফুলের ঝাড়ে সেজে ওঠা ইছামতীর তীর। মনে পড়ছে ঘরের কথা, ঘরের মানুষদের কথা, বারাকপুরের কথা… যেখানে কেউ নেই আজ, অথচ কতজনেরই তো থাকার কথা ছিল! কোথায় গেল তারা?
ছেলেবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছেন। কয়েক বছর আগে মা, তার কিছুদিন বাদে প্রথমা স্ত্রী মারা গেছেন। আজ জন্মভিটে থেকে বহুদূর। জানা নেই আদৌ কোনওদিন ফিরতে পারবেন কি না। এক অদ্ভুত উচাটন, এক অব্যক্ত আকুতির টানেই যেন পাতার পর পাতা জুড়ে বেদনার ভাষ্য অহর্নিশ লিখে চলেছেন।
বসন্ত গড়িয়ে গ্রীষ্ম। ফের বর্ষা পেরিয়ে শরৎ। কিছুদিনের ছুটি। উপন্যাসের পাট মোটামুটি গোটানো। এরই মধ্যে বাঙালি বাবুটি কলকাতা যাওয়া মনস্থির করলেন। ইচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার। নতুন লেখা আখ্যান পড়ে শোনাবেন তাঁকে৷ হাতে তুলে দেবেন খসড়া। চাইবেন পরামর্শ। ভুলচুক থাকলে করতে হবে সংশোধন। লেখা আদৌ দাঁড়িয়েছে কি না, বুঝে নিতে হবে তাও৷
যাওয়ার আগে লেখক ভাগলপুরে রঘুনন্দন হলে একটি অনুষ্ঠানে এসেছেন। হাতে ব্রিফকেস। এরই মধ্যে রয়েছে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। একমনে ভেবে চলেছিলেন নিজের সদ্যোজাত রচনা নিয়ে: আহামরি কিছুই তো নেই এতে! স্রেফ এক কিশোরের বেড়ে ওঠার গল্প। তার চোখ ফুটে চারদিক চেয়ে দেখার কথা। প্রকৃতি, সমাজ, মানুষ ওই বাচ্চা ছেলেটির মনে কীভাবে ঢেউ তুলছে—তারই সাদামাটা বর্ণনা। আর যা কিছু আছে, সবই চালচিত্রের মতো৷ এত আঁকাড়া, এত সহজ সুরের গল্প রবিবাবুর পছন্দ হবে তো?
ভাবতে ভাবতে চোখ গেল গেটের কাছে। আর তীব্র, জোরালো ধাক্কায় সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি। এক দেহাতি মেয়ে ভিড়ের ফাঁক গলে কীভাবে যেন হলঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। বাচ্চা মেয়ে। আদুর গা। উস্কো-খুস্কো চুল। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে চলেছে। কারও দিকে ভ্রূক্ষেপ করছে না সে। দেখেই মনে হচ্ছে হয় স্কুল পালিয়েছে। নয়তো বাড়ি থেকে মারের ভয়ে লুকিয়ে এসেছে। আর এদিক-সেদিক চেয়ে নতুন কোনও দুষ্টুমির মতলব এঁটে চলেছে।
কয়েক পলক মাত্র। তারই মধ্যে শরতের বিবাগি বাতাসের টানে মেয়েটি যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই ভিড়ের পুঞ্জে মিলিয়ে গেল। চলে গেল। কিন্তু মনে একটা রেশ উঠল আচম্বিতে। ফের একবার আনমনা হয়ে গেলেন তিনি। চেয়ার ঠায় বসে থাকলেন। তারপর কাউকে কিচ্ছুটি না বলেই বেরিয়ে এলেন।
না, স্টেশন নয়। বদলে ভাগলপুরেই তাঁর আস্তানা ‘বড় বাসা'-য় ফিরে গেলেন লেখক। কলকাতা যাওয়া হল না। হল না বলা ভুল। ওই দেহাতি মেয়ে, তার চোখে ফুটে ওঠা ওই ‘ব্যথাভরা জগৎ’-ই যেন তাঁকে ফিরিয়ে আনল। ফের টেবিল-চেয়ার পেতে বসে পড়লেন। ব্রিফকেস থেকে এক ঝটকায় বের করলেন মাসের পর মাস ধরে লিখে চলা পাণ্ডুলিপির খসড়া। তারপর একটানে ছিঁড়ে ফেললেন সমস্তটা। সময় নেই। সময় নেই একদম। ‘রিকাস্ট’ করতে হবে। পুরো প্লট ঢেলে সাজাতে হবে। ওই উস্কো-খুস্কো চুল, দুষ্টুমিভরা চাহনিকে উপন্যাসে ঠাঁই না দিলে শান্তি মিলবে না, মিলবে না তৃপ্তি।
আবার দিন ঘুরে মাস। মাস পেরিয়ে বছর। পাক্কা এক বছর ধরে অল্প অল্প করে উপন্যাসটি নতুন আঙ্গিকে লেখা হল। বাচ্চা ছেলেটি রইল। রইল তার বিস্ময়ভরা দু'চোখ। কিন্তু নতুন চরিত্র হিসেবে জায়গা করে নিল একটি মেয়ে। শরতের এক সকালে যে নিমেষের জন্য দিয়েছিল দেখা। নাম দিলেন ‘দুর্গা’। কিশোর ‘অপু’র দিদি। চালচিত্র ভরাট হল এবার। অপুর হাত ধরে রইল দুর্গা। উপন্যাসে, জীবনেও।
তিন বছর ধরে (১৯২৫-১৯২৮) পুরোদস্তুর রদবদলের পর ‘পথের পাঁচালী’র চূড়ান্ত খসড়া এভাবেই প্রস্তুত করেছিলেন কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে রাখা পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টালেই তার সাক্ষ্য মেলে। দুর্গা ছাড়া, শুধুমাত্র অপুকে কেন্দ্র করে, প্রথম ম্যানুস্ক্রিপ্ট রচিত হয়েছিল। কিন্তু ভাগলপুরের ওই আপাততুচ্ছ ঘটনা বিভূতিভূষণের মনে এমন ঢেউ তুলে দিয়ে যায় যে, আগের নকশা বদলে ফের নতুন করে সাজিয়ে তোলেন গোটা উপন্যাস। লেখা হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম স্মরণীয় ‘কার্টেন রেজার’: ‘নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের একেবারে উত্তরপ্রান্তে হরিহর রায়ের ক্ষুদ্র কোঠাবাড়ি… পূর্বদিন ছিল একাদশী। হরিহরের দূরসম্পর্কীয় দিদি ইন্দির ঠাকরুণ সকালবেলা ঘরের দাওয়ায় বসিয়া চালভাজার গুঁড়া জলখাবার খাইতেছে। হরিহরের ছয় বৎসরের মেয়েটি চুপ করিয়া পাশে বসিয়া আছে ও পাত্র হইতে তুলিবার পর হইতে মুখে পুরিবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিমুঠা ভাজার গুঁড়ার গতি অত্যন্ত করুণভাবে লক্ষ্য করিতেছে…’
ঋণ:
১. বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়: বিভূতি রচনাবলী (প্রথম খণ্ড)
২. পরিমল গোস্বামী: সপ্তপঞ্চ
৩. ‘দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকা (বিভূতিভূষণ সংখ্যা)