শেষ আপডেট: 14th April 2024 07:37
আজ পয়লা বৈশাখ। একটি দিনের পার্বণ। আগামিকাল, সোমবার থেকে কাজে ব্যস্ত বাঙালি ভুলে যাবে ২ বৈশাখের কথা। কিন্তু, কত বঙ্গাব্দ? অনেকেই হেঁচকি তুলবেন এমন ক্যুইজের প্রশ্ন শুনে। ১৪৩১ বঙ্গাব্দ। ব্যস, তারপর ফের মনে করার জন্য হাতে রইল ৩৬৫টি দিন। এদিন রবিবার হওয়ায় বাঙালির পেটপুজোয় কোনও খামতি যাবে না। রেস্তরাঁগুলি এখন থেকেই কোমর বেঁধে ভিয়েন বসিয়েছে। ব্যবসায়ীরা ভোররাত থেকে লাইন দেবেন কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বরসহ বিভিন্ন মন্দিরে। নাম কা ওয়াস্তে হবে হালখাতা। খাতা কোথায়! সে পাট তো কবে চুকে গিয়েছে। লক্ষ্মী-গণেশ দুই ভাইবোন বেতের চুবড়িতে লাল গামছা জড়িয়ে গদিঘরে আসন পাতবেন। হাসালেন, গদিঘর কাকে বলে? এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার হতে হবে।
আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি বৃদ্ধ হয়েছে। সেই কবে থেকে দেশ যা কাল ভাবে, বাঙালিরা তা আজ ভাবতে ভাবতে চোখে পড়েছে ছানি। এককথায় বললে ভীমরতি ঘটেছে বঙ্গ সমাজের। তাই আমরা ভুলে গিয়েছি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বাবা-মা, গুরুজনদের প্রণাম করার রীতি। বাড়ির কেন পাড়ার বয়স্কদেরও পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে হতো। সকলের আশীর্বাদ কপালে জুটলে নিজেকেই কেমন সুখী বলে অনুভব হতো।
আকাশবাণী কলকাতা। এখন বিলুপ্তপ্রায় সেই বেতার জগতের যুগে ভোরে বাজত রবীন্দ্র সঙ্গীত। মনটায় কেমন চৈত্র পবন বয়ে যেত। আগের দিনে দেখতে যাওয়া চড়ক মেলা, গাজনের গান, গাজন সন্ন্যাসীদের ঝাঁপান সব কিছুতে কেমন চালসে ধরে গিয়েছে। গরম আলুর দম, ঘুগনি আর পাঁপড় ভাজা যে বেড়াতে বেরিয়ে খাদ্যতালিকায় আসতে পারে, তা ভাবতে পারে কজন তরুণ। কপাল খুব খোলতাই থাকলে জুটত বাদাম চিট কিংবা বুড়ির চুল বা হাওয়াই মিঠাই।
দূরদর্শনের যুগে শুরু হল বৈশাখী আড্ডা। সাদাকালো বা রঙিন টিভির সামনে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, ঋতু গুহ, বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিভাস চক্রবর্তীর মতো ব্যক্তিত্বরা। গান-আড্ডা-স্মতিচারণে কখন ভাটা চলে গিয়ে গঙ্গার জলে লেগে যেত জোয়ারের স্রোত।
বছরের প্রথম দিন সকাল সকাল স্নান সেরে নিতে হতো। স্নান করে উঠলেই জুটত যার যেমন সাধ্য তেমন নতুন পোশাক। জামা-কাপড় যদি নাই জোটে, নিদেনপক্ষে গেঞ্জি একটা কপালে লেখা থাকত। মা-বাবারাও কিছু না কিছু নতুন পোশাক পরতেন। পুজো দিতেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়। সকালে নিয়মমাফিক একবার পড়তে বসতে হতো। তা সে যতটুকু সময়ের জন্যই হোক না কেন।
বেশ মনে পড়ে, বাজারে সকাল থেকে ভিড় উপচে পড়ত। মাছ, মাংস ও মিষ্টির দোকানে লাইন পড়ে যেত। ওং, উদারায় নমঃ। মাছের জন্য তখন আলাদা থলি থাকত। যা অত্যন্ত আলগোছে তরিতরকারির থলির সঙ্গে না ঠেকিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসাই ছিল এক চরম পরীক্ষা। মাছ-মাংসের থলির প্রবেশ হেঁসেলে নয়, বাইরের দাওয়ায়। সেখানে বেছে-ধুয়ে তবে তাঁরা ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেতেন।
একটু বেলা হতেই পাড়ায় পাড়ায় গলি থেকে গলিতে গৃহস্থবাড়ি থেকে ভেসে আসত লুচি ও আলুর সাদা তরকারির নির্ভেজাল জিভে জল আনা গন্ধ। দুপুরে গরম ভাতের সঙ্গে ডাল, ভাজা, মাছ ও খাসির মাংস। উমম, তখন হিন্দুদের বাড়িতে মুরগির ডিম, মাংস ঢোকা ছিল নিষিদ্ধ। ফলে হৃদয়ের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে বাঙালি নিশ্চিন্তে রেওয়াজি খাসি কিংবা কচি পাঁঠা সাঁটাতেন চিত্তভরে।
বেলা গড়িয়ে বিকেল হলেই সাজসাজ রব। বাবার হাত ধরে বেরনো হালখাতা করতে। সেটা কী! সেটা হল, যে যে দোকান থেকে সারাবছরের খরিদ করা হতো, সেই সেই দোকানে গিয়ে নববর্ষের খাতাপুজোর নিমন্ত্রণ রক্ষা করা। যেমন, শাড়ি, জামাকাপড়ের দোকান, মুদির দোকান, মিষ্টির দোকান ইত্যাদি। আর্থিক দুর্দশার কারণে যে পরিবার সোনার দোকানে গয়না বন্ধক রাখতেন, তাঁরা সুদসহ টাকা ফেরত দিয়ে স্ত্রীর গলার হার ঘরে ফেরাতেন। কিংবা তা না পারলে সামান্য কিছু জমা করলেও মিলত ক্যাম্পাকোলা, বিজলি গ্রিলের আইসক্রিম সোডা, এক বাক্স মিষ্টি ও নোনতা খাবার এবং একটি করে দুর্গা, কালী, রামকৃষ্ণ, শিব, তারামায়ের ছবি দেওয়া বাংলা ক্যালেন্ডার। তাতে পূর্ণিমা, অমাবস্যা, একাদশীর সময়ক্ষণ দেওয়া থাকত। সারা বছর ওই ক্যালেন্ডার দেখেই চলত বাঙালি ঘরের নিরামিষ-আমিষ রান্নার দিনযাপন।
এভাবেই একটা সময় রাতে আর কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়ত বাঙালি। দোকান দোকান থেকে আনা প্যাকেট আর প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাওয়া কাঁসার রেকাবিতে মিষ্টি ও পায়েস খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত কলকাতা। আধো ঘুমে শোনা যেত, পাশের বাড়ির মাসিমা বা জেঠিমা সদর দরজায় দাঁড়িয়ে বলছেন, উনি খুব করে বললেন তাই একটু পায়েস করেছিলাম আর কী! নিজের সন্তান নয় তো কী হয়েছে, আজ পয়লা বৈশাখ তো!