শেষ আপডেট: 8 March 2024 17:26
দ্য ওয়াল ব্যুরো: তমলুক মহকুমায় গয়না-বড়ি দেখে কলাভবনে ছবি তুলে সাজিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শোনা যায় কবিগুরু নাকি বলেছিলেন, ‘গহনা বড়ি শুধুমাত্র দেখার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়’। তা সে কালের মেয়ে-বউরা নিষ্ঠা সহকারে বড়ি দিতেন। কাঁসার থালায় তেল মাখিয়ে ডালের বড়ি বা পোস্ত বিছিয়ে নানা আকারের গয়না বড়ি দেওয়ার সে রেওয়াজ এখন আর কোথায়। আগে তো বাংলার ঘরে ঘরে ছাদে কাপড় বিছিয়ে বড়ি দিতে দেখা যেত মা-ঠাকুমাদের। বাড়ির বড়রা বলতেন, বড়ি দিতে হলে শুদ্ধ হয়ে নিতে হবে। স্নান করে খোলা চুল পিঠে বিছিয়ে ছাদে বসতেন মায়েরা। ফেটানো ডাল মাখা নিয়ে ছোট ছোট বড়ি দিয়ে যেতেন কাঁসার থালা বা বিছানো চাদরে। বড়ি দেওয়ার ছন্দে হাতে রিনরিন করে বাজত শাঁখা-পলা। বড়ি যতক্ষণ না শুকোচ্ছে ততক্ষণ ছাদে বসে রোদ পোহানোও চলত।
সেসব হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা। বাঙালির ঘরে ঘরে বড়ি দেওয়ার দৃশ্য এখন প্রায় অদৃশ্য। বাজার থেকে কিনে আনা বড়ি দিয়েই শুক্তো, চচ্চরি, ডালনা, মাছের ঝোল রান্না হচ্ছে। বাড়িতে তৈরি বড়ি রোদে কটকটে শুকিয়ে মুচমুচে করে তেলে নেড়ে শুক্তোর স্বাদ বাঙালি ভুলতেই বসেছে। সে বড়ি দিয়ে শাক চচ্চড়ি অমৃতের মতো। এক থালা ভাত হাপুসহুপুস করে এমনিই উঠে যেত। শীতের নিভু নিভু রোদে বাঙালি গৃহস্থ বাড়ি থেকে হাতে তৈরি ডালের বড়ি ভাজার মিষ্টি গন্ধ ম ম করত পাড়ায়। বাঙালি বড়ি দেওয়ার রেওয়াজ ভুললেও, এ বাংলায় এমন গ্রাম আছে যেখানে ঘরে ঘরে মেয়ে-বউ, পুরুষরা যত্ন করে বড়ি দেন আজও। এই গ্রামের নাম সুকান্তপল্লি, জেলা বর্ধমান।
গাঁয়ের প্রায় সব বাড়িতেই বড়ি দেওয়ার রীতি আছে। বড়ি বেচেই রোজগার এই গ্রামের মানুষজনের। গোটা গ্রামের প্রায় সকলেই বড়ি দিতে জানেন। হাতে তৈরি বড়ির পাশাপাশি বেশি জোগান দিতে মেশিনে তৈরি বড়িও বানাচ্ছেন গ্রামবাসীরা।
পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রামের একটি গ্রাম হল সুকান্তপল্লি। এই গ্রামকে বড়ি গ্রাম নামেই জানেন বেশিরভাগ মানুষ। বড়ি বেচেই পেট চলে গ্রামবাসীদের। গ্রামে ঢুকলেই নাকি দেখা যায়, চাদর বিছিয়ে সার বেঁধে বড়ি দিচ্ছেন সকলে। এখন আবার বড়ি দেওয়ার আধুনিক পদ্ধতিও হয়েছে। গ্রামের কোনও পরিবার ২০ বছর, কেউ আবার ৩০-৪০ বছর ধরে বড়ি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কলকাতা থেকে মেশিন এনেও চলছে ব্যবসা।
চড়া রোদে মাঠে কাপ বিছিয়ে বড়ি দিতে দিতে এক গ্রামবাসী বললেন, বড়ি শুকনো, প্যাকেজিং এসবের খরচ বেড়েছে। বড়ি দু’রকমের হয়—হাতে তৈরি বড়ি আর মেশিনে তৈরি বড়ি। মেশিনের বড়ির দাম কম। হাতে তৈরি বড়ির এখনও দাম রয়েছে ভাল। আর ভাল মানের গয়না বড়ি হলে তার জন্য দু’চার পয়সা বেশি আয় হয়।
আগে বড়ি দেওয়ার জন্যই অনেকে বাড়িতেই চালকুমড়োর চারা লাগাতেন। মশলা বড়ির আরেকটা ধরন হল ‘কুমড়ো বড়ি’। পরে শীত এলে ডাল বেটে রোদে বসে মহিলারা লেগে পড়তেন বড়ি দিতে। রোদে শুকিয়ে মচমচে হওয়া সেই বড়ি নানা তরকারিতে মিশিয়ে বছরভর খাওয়া হত। তবে সকলের সেরা গয়নাবড়ি। এর জন্য মেদিনীপুরের বনেদি পরিবারগুলোকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, মহিষাদল, কাঁথি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমায় বনেদি বাড়ির গিন্নিরা নানা রকম আকারের নকশাদার গয়নাবড়ি তৈরি করেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ সিনেমায় উৎপল দত্তের পাতে যে গয়নাবড়ি দিয়েছিলেন মমতা শঙ্কর তা এসেছিল ময়না রাজ পরিবার থেকে। এখনও মেদিনীপুরের অনেক জায়গাতেই বনেদি বাড়িতে গয়না বড়ি দেওয়ার রেওয়াজ আছে।
সুকান্তপল্লির বড়ি-ব্যবসায়ীরা অবশ্য এখন ডালের বড়ি বা চালকুমড়োর বড়িই বেশি তৈরি করছেন। নানারকম মশলা বড়িও আছে। ডাল এক রাত ভিজিয়ে রেখে পরদিন ভাল করে শিল-নোড়ায় বেটে ফেটাতে হয়। যত ফেটানো হবে, তত বড়ি হালকা আর মুচমুচে হবে। বিউলির ডালের বড়ি হলে আবার ভাল করে ঘষে পরিষ্কার করে নিতে হয়। খুদ, খোসা বা অন্যকিছু যেন মিশে না থাকে। মিহি করে ডাল বেটে শুরু আসল কাজ, ফেটানো। বড় গামলায় ফেটাতে হয়। যত ফেটানো হবে তত ফুলে উঠবে ডালবাটা। শেষ দিকে ফোমের মতো হয়ে যাবে। একটু ডাল বাটা নিয়ে এক বাটি জলে ফেলে দেখতে হয়। ভেসে উঠলে বোঝা যাবে কাজ হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীতের সকালের হালকা রোদ বড়ি শুকনো করার আদর্শ। কড়া রোদে বড়ি ভেঙে যায়। চড়া রোদে পাতলা কাপড়ে ঢেকে দিতে হয়। বর্ষাকালে খুব সমস্যা হয়। ব্যবসা দেখতে গেলে আর ঋতু বদলের সময় বাছবিচার করলে চলে না। সারা বছরই তাই সুকান্তপল্লির রাস্তায়, বাড়ির ছাদে, খোলা মাঠে বড়ি দেওয়ার কাজ চলে। আজন্ম চলবেও। বাংলার ঐতিহ্যকে শক্ত হাতে বাঁচিয়ে রেখেছে আউশগ্রামের সুকান্তপল্লি।