শেষ আপডেট: 14th March 2025 16:09
দ্য ওয়াল ব্যুরো, পূর্ব বর্ধমান: দোল পূর্ণিমায় সারা বাংলা মাতোয়ারা থাকে রঙের উৎসবে। কিন্তু প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে এই দিনটিতে আবিরের রঙে রাঙা হয় না রাঢ়বঙ্গের অন্যতম প্রাচীন শহর বর্ধমানের বাসিন্দারা। এখানে রঙের উৎসব পালিত হয় দোল পূর্ণিমার পরের দিন। রাজা না থাকলেও শতাব্দী প্রাচীন রাজ ঐতিহ্য মেনেই চলে আসছে এই রীতি। একই রকম ভাবে সাবেকী রীতি মেনে জেলার জামালপুর ব্লকের ’রাধাবল্লভবাটি’ মৌজার বাসিন্দারাও দোলের দিন আবিরের রঙ থেকে দূরে থাকেন। দোল পূর্ণিমার পরদিন এই এলাকায় পালিত হয় দোল উৎসব । যা ’জোড়া রাধাবল্লভের’ দোল নামেই খ্যাত ।
দোল পূর্ণিমার দিন বর্ধমানবাসীর রঙের উৎসবে মাতোয়ারা না হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে নানা কাহিনী। কথিত আছে, বর্ধমানের মহারাজা বিজয় চাঁদ মহতাব এই প্রথা চালু করেন। পঞ্জিকা মতে দোল পূর্ণিমার দিনটিকে বর্ধমানের অধিষ্টাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা দেবীর দোল হিসাবে মানা হয়। এও কথিত আছে বর্ধমানে দোল পূর্ণিমা তিথিটি হল ঠাকুর দেবতার দোল উৎসবের দিন। সেদিন শুধুমাত্র দেব-দেবীর চরণ আবির ও কুমকুমে চর্চিত হবে। সেই উপলক্ষে রাজবাড়ির অন্দর মহলে দোল খেলা হয়ে থাকে। পরের দিন অনুষ্ঠিত হয় বর্ধমানের সাধারণ মানুষের রঙের উৎসব। আজও সেই রীতি মেনে চলেছেন বর্ধমানের মানুষ। ঐতিহ্য মেনে আজও দোল পূর্ণিমা তিথিতে প্রাচীন বর্ধমানের প্রাণকেন্দ্র সর্ব্বমঙ্গলা বাড়িতে দোল উৎসব পালিত হয় এবং বর্ধমানবাসী পরের দিন দোল উৎসব পালন করেন ।
বর্ধমানের মতোই একই ঐতিহ্য মেনে দোল পূর্ণিমা তিথি শেষ হলে ’জোড়া রাধাবল্লভের’ দোল উৎসবে মাতোয়ারা হন পূর্ব বর্ধমান জেলার জামালপুরের রাধাবল্লভবাটি মৌজা এলাকার বাসিন্দারা। প্রায় চারশো বছর ধরে জোড়া রাধাবল্লভ পূজিতা হয়ে আসছেন জামালপুরের রায় পরিবারের মন্দিরে। রাধাবল্লভের চরণে আবির দিয়ে তারপর বিকালে জামালপুরবাসী রঙের উৎসবে মাতোয়ারা হবেন। ওইদিন মন্দির প্রাঙ্গনে বসে মেলা। জোড়া রাধাবল্লভের পুজো দেখতে আশপাশ এলাকার বহু মানুষ ওইদিন মন্দির প্রাঙ্গনে জড়ো হন। জেলায় আজও অন্যতম ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে জোড়া রাধাবল্লভের দোল উৎসব ।
জামালপুরের রায় পরিবারের সদস্য প্রশান্ত রায় জানান,“তাঁদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন রাজপুত । প্রায় চারশো বছর আগে রাজস্থান থেকে বর্ধমানে বাণিজ্য করতে এসেছিলেন রাজপুত সিংহ বংশীয় তাঁদের এক পূর্বপুরুষ। অবিভক্ত বর্ধমান জেলার জামালপুরে তিনি আস্তানা গাড়েন। শত্রু আক্রমণ ঠেকাতে গড় কাটা হয় আস্তানার চারপাশ জুড়ে। সেই গড়কাটার সময় মাটি থেকে উদ্ধার হয় রাধাকৃষ্ণের অষ্টধাতুর একটি মূর্তি। রাধাকৃষ্ণ মূর্তিটি রাজপুত পরিবারের কাছে রাধাবল্লভ নামে পরিচিতি পায় । আস্তানা এলাকায় ছোট্ট একটি মন্দির গড়ে রাধাবল্লভের মূর্তির পুজোপাঠ শুরু করেন তদানীন্তন রাজপুত পরিবারের সদস্যরা। সেই সমসাময়িক কালেই কোনও এক বৈষ্ণব সাধক ওই মন্দিরের সামনে কষ্টিপাথরের একটি কৃষ্ণ মূর্তি এবং অষ্ট ধাতুর একটি রাধা মূর্তি ফেলে রেখে দিয়ে চলে যান। সেই থেকেই দোল পূর্ণিমা তিথি পরবর্তীতে প্রতিপদ তিথিতে জোড়া রাধাবল্লভের মূর্তির পুজোপাঠ হয়ে আসছে রাধাবল্লভ মন্দিরে।
রায় পরিবারের অপর সদস্য পার্থপ্রতিম রায় জানালেন, দোল পূর্ণিমার দিন রাধাবল্লভ মন্দির প্রাঙ্গনে পরিবারের সদস্যরা মিলে চাঁচর পোড়ান । পূর্ণিমা শেষে প্রতিপদ তিথিতে বংশের মন্দিরে হয় রাধাবল্লভের পুজোপাঠ। রাধাবল্লভের ভোগ অন্নে শুক্তো থাকতেই হবে। পুজোপাঠ শেষে রাধাবল্লভের চরণে আবির দিয়ে বিকালে মন্দির চত্বরে এলাকাবাসী রং খেলায় মাতেন। সন্ধ্যায় বিতরণ করা হয় অন্ন ভোগ ।