শেষ আপডেট: 30th October 2024 14:31
দ্য় ওয়াল ব্যুরো, পূর্ব বর্ধমান: বর্গী হানায় এক সময়ে তছনছ হয়ে গিয়েছিল সারা বাংলা। তার রেশ আছড়ে পড়েছিল পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামেও। প্রায় পাঁচশো বছর আগের সেই বর্গী হামলায় আশ্রয় হারাতে হয়েছিল ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের আরাধ্য দেবী বড়মাকেও। তাঁর ঠাঁই হয়েছিল শ্মশান সংলগ্ন পরিত্যক্ত জায়গায়। সেখানেই দীর্ঘদিন তিনি পড়েছিলেন। কথিত, স্বপ্নে দেবী এই গ্রামের বাসিন্দা বুদ্ধদেব সরকারকে সে কথা জানান। তারপরেই দেবীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে বুদ্ধদেববাবু প্রথম পুজোপাঠ শুরু করেন। পরে মন্দির গড়ে তিনি সেখানে বড়মাকে প্রতিষ্ঠা করেন ।
সেই থেকে প্রতি বছর কার্তিকের অমাবস্যা তিথিতে ওঁয়াড়ি গ্রামে ঘটা করে হয়ে আসছে বড় মায়ের পুজো। বর্গীদের মহিষাসুরের সঙ্গে তুলনা করে বড়মায়ের পুজোয় এক সময়ে মোষ বলি হত। সেই সময়ে মহিষাসুর বধের উল্লাসে বড়মার প্রতিমার সামনে লাঠি খেলায় মাতোয়ারা হতেন ওঁয়াড়ি গ্রামের হিন্দু ও মুসলিম যুবকরা। এখন মোষ বলি আর না হলেও পুরনো প্রথা মেনে কালী পুজোর দিন বড়মার সামনে হয় লাঠি খেলা ।
ওঁয়াড়ি গ্রামে বড়মা দেবীরূপে পূজিতা হলেও আদতে তিনি হলেন দুর্গাকালী রূপী। বড়মার প্রতিমা প্রকৃত অর্থেই নজরকাড়া। গণেশ, কার্তিক ,লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সঙ্গে দুই পরী জয়া ও বিজয়াকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠিতা দুর্গা কালীরূপী বড়মা। নিজের মাহাত্ম্য গুণেই বড়মা ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে অনন্য দেবীরূপে ভূষিতা হয়েছেন। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, বড়মায়ের কাছে কেউ কিছু চাইলে বড়মা তাকে নিরাশ করেন না ।
আগে গ্রামের সরকার বাড়িতে পূজিতা হতেন বড়মা ।এখন তিনি পূজিতা হন ওঁয়াড়ি গ্রামের সকলের বড়মা রূপে ।দেবীর মন্দিরটিও তৈরি হয়েছে বিশাল আকারে। শোনা যায় একসময়ে বড়মায়ের নামে প্রায় সাড়ে সাতশো বিঘে জমি ছিল। সেসব ইতিহাস। এখন ৩০-৩৫ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি রয়েছে বড় মায়ের নামে ।সেই জমির আয় থেকেই সারা বছর বড়মায়ের নিত্য সেবা ও কার্তিকেয় অমাবস্যা তিথিতে বিশেষ পুজোপাঠ হয়। পুজো চলে সাতদিন ধরে।
পুজারী তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, "কালীপুজোর দিন থেকে শুরু হয়ে সাত দিন ধরে চলে বড়মার বিশেষ পুজোপাঠ ।তন্ত্র মতেই হয় সেই পুজো। দেবীর ভোগে চালকলাই ভাজা ও চিনি দিতে হয়। আগে মহিষাসুর বধকে স্মরণ করে হত মোষ বলি। তবে এখন আর হয় না। রীতি মেনে ছাগ,আখ ও ছাঁচি কুমড়ো বলি দেওয়া হয়।" গ্রামের বাসিন্দাদের কেউ কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও পুজোর সাতটি দিনের জন্য সবাই ফিরে আসেন গ্রামে ।পুজোর সাতদিন উৎসবমুখর থাকে ওঁয়াড়ি গ্রাম। এলাকায় বসে বিশাল মেলা। হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালা।
ওঁয়াড়ি গ্রামের বাসিন্দা মধুসূদন চন্দ্র জানান, কথিত আছে চরম দারিদ্রের মধ্যে দিনযাপন করতেন গ্রামের সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষ বুদ্ধদেব সরকার। উদাস মনের এই মানুষটি কালী মায়ের ভক্ত ছিলেন। গ্রামের প্রবীণদের কাছে তিনি শুনেছেন ওঁয়াড়ি গ্রামের একপাশে ছিল শ্মশান ঘাট । সেখানে নিজের পোষা গরু চরাতে যেতেন বুদ্ধদেব বাবু । গরু চরাতে চরাতে একদিন সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। স্বপ্নে বড়মা তাকে দেখা দেন। বুদ্ধদেবকে বলেন, বর্গী হামলায় সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। বর্গীরা সব মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে। শ্মশান থেকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। বুদ্ধদেব দেবীকে বলেন, আমি নিজেই দু’বেলা খেতে পাইনা। তোমাকে প্রতিষ্ঠা করে কী খাওয়াব? তখন দেবী বুদ্ধদেবকে বলেন, সামান্য চাল কলাইভাজা আর একটু চিনি দিলেই তাঁর খাওয়া হয়ে যাবে। বড়মা লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশকেও প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতে বলেন। সেই নির্দেশ মেনেই বুদ্ধদেব সরকার বড়মার পুজোপাঠ শুরু করেন। সেই থেকে গণেশ,কার্তিক, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে সঙ্গে নিয়েই দুর্গাকালী রূপে ওঁয়াড়ি গ্রামে পূজিতা হয়ে আসছেন বড়মা ।