শেষ আপডেট: 4th January 2025 16:08
১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর, পার্লামেন্ট অধিবেশনে বোমা চার্জ করে ইংরেজদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ভগৎ সিং। ভয় পেয়েছিল ইংরেজ সরকার। লাহোরে অত্যাচারী ইংরেজ পুলিশ অফিসার সন্ডার্সকে হত্যা করেন। সেদিন ভগৎ সিংয়ের সঙ্গী ছিলেন বটুকেশ্বর দত্ত। এই বাংলার মাটিতেই তাঁর জন্ম।
তারপর থেকে দুই বিপ্লবীকে ধরতে ইংরেজ পুলিশ শুরু করে চিরুনি তল্লাশি। গ্রেফতারি এড়াতে ইংরেজ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভগৎ সিংকে সঙ্গে নিয়ে ওয়ারি গ্রামে চলে আসেন বটুকেশ্বর দত্ত।
বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষের ওয়ারি গ্রাম। এই গ্রামেই জন্ম হয় বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের। দোতলা এই মাটির বাড়ি বটুকেশ্বরের পৈতৃক ভিটে। এক দিদি মা-বাবাকে নিয়ে ছিল বটুকেশ্বর দত্তের সংসার। ছেলে বিপ্লবীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে, সে কথা জানতে পেরেই ছেলেকে দর্জির কাজ শিখতে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন বটুকেশ্বরের বাবা।
কলকাতায় আসার পর যতীন দাসের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাঁর কাছেই বোমা বাঁধার প্রশিক্ষণ নেন বটুকেশ্বর দত্ত। এরপরেই ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে পার্লামেন্টে হাউজে বিস্ফোরণ কাণ্ড ঘটান।
তবে শুধু বটুকেশ্বরই নন, এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভগৎ সিংয়ের স্মৃতিও। ইতিহাস গবেষক রমজান আলীর দাবি, 'ইংরেজ অফিসার সান্ডার্স হত্যার পরে বটুকেশ্বরে সঙ্গে এই গ্রামে গা ঢাকা দেন ভগৎ সিং। বটুকেশ্বেরের এক প্রতিবেশী নিজের বাড়িতে তাঁদের আশ্রয় দেন। এই সেই বাড়ি। এখানেই ১৫ দিন আন্ডার গ্রাউন্ডে কাটিয়েছিলেন ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর। এই সময়ে পার্লামেন্টে হামলার ছক কষেন তাঁরা।
তবে আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে সেই বাড়ি। দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীর স্মৃতি বিজরিত বাড়ি সংরক্ষণের জন্য অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয় সরকার। তবে শরীকি বিবাদ থাকার ফলে এই জমি অধিগ্রহণ করা যায়নি। ফলে এই বাড়ির পাশেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি মিউজিয়াম। সেখানে বটুকেশ্বর ও ভগৎ সিংয়ের আবক্ষ মূর্তি রয়েছে।
প্রতিবছর ১৮ নভেম্বর বটুকেশ্বর দত্তর জন্মদিনে সেজে ওঠে গ্রাম। ভূমিপুত্রের আত্মত্যাগকে স্মরণ করেন সেখানের মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামী বটুকেশ্বর দত্তের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে একটি কমিটি ও ওয়েলফেলার ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের সম্পাদক মধুসূদন চন্দ্র।
বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি মধুসূদন চন্দ্র বলেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বটুকেশ্বর দত্ত যেমন মর্যাদা পাননি, তেমনই বছরের পর বছর ধরে অনাদরেই পড়ে ছিল বিপ্লবীর বসত বাড়ি ও ভিটা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বটুকেশ্বর দত্তের বসতবাড়ি, ভিটে ও তার লাগোয়া নগেন্দ্রনাথ ঘোষেদের সেই পাতাল ঘর ’হেরিটেজ’ স্থান হিসাবে ঘোষণা করা হয়।'
তিনি আরও জানান, এরপর ২০১৩ সালে রাজ্যের পর্যটন দফতর বটুকেশ্বর দত্তের জন্মভিটে ও পৈতৃক বাড়ি এবং ওই পাতাল ঘর সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বসত ভিটে-সহ মাটির দেওয়াল ও টিনের চালার বাড়ির কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে হয় সংস্কার কাজ।
স্থানীয়দের মতে, 'এটা আমাদের সৌভাগ্যের যে বটুকেশ্বর দত্তের মতো একজন দেশবরেণ্য বিপ্লবী খণ্ডঘোষের ওঁয়াড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের সহযোগী হিসেবে অতি অল্প বয়সেই বটুকেশ্বর দত্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ সব মহান বিপ্লবীরা যখন দেশের স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখন মানুষের মধ্যে কোনও বিভেদ ছিল না। কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে শিখ, কে ধনী, কে গরিব এই সব কোনও বিচার্য বিষয়ই ছিল না।'
কয়েকদিন আগে বোঁয়াইচণ্ডী স্টেশনের নাম বটুকেশ্বর দত্তের নামে করার দাবি ওঠে। বটুকেশ্বর দত্ত স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সম্পাদক মধুসূদন চন্দ্র জানিয়েছেন, 'বর্ধমান স্টেশন না হলেও যদি বোঁয়াইচন্ডী স্টেশন বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের নামে হয়, তাহলে আমাদের মনে হয় বটুকেশ্বর দত্তকে উপযুক্ত সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। জেলাশাসক বলে গিয়েছেন এই বিষয়ে আমরা আবেদন জমা দেব।'