প্রতীকী ছবি।
শেষ আপডেট: 30th August 2024 17:02
দ্য ওয়াল ব্যুরো: আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস ধর্ষণ ও খুন নিয়ে উত্তাল গোটা রাজ্য তথা দেশ। প্রতিবাদে-বিক্ষোভে প্রায় প্রতিদিন গর্জে উঠছে শহর কলকাতা। বিচার চেয়ে গলা ফাটাচ্ছেন চিকিৎসক মহল থেকে শুরু করে সমস্ত স্তরের সাধারণ মানুষ। সকলেই আশা করছেন, অপরাধীরা ঠিক ধরা পড়বে। কেবল বালুরঘাটের পূর্ণিমা যেন ধরেই নিয়েছেন, কিছুই হবে না। আসল অপরাধীদের শাস্তি অধরাই থেকে যাবে। ঠিক যেমন থেকে গেছে, তাঁর দিদির ক্ষেত্রে! ৪২ বছর ধরে অপেক্ষা করে থেকেও বিচার পাননি তিনি ও তাঁর পরিবার।
সালটা ১৯৮২। এমনই এক বর্ষাকালে, বৃষ্টির রাতে কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের নার্সের উপর ভয়াবহ নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। অনেকটা আরজি করের তরুণীর মতোই। নার্স বর্ণালী দত্তকে নৃশংস ভাবে খুন হতে হয়েছিল। তদন্তে জানা গেছিল, খুনের আগে তাঁকে করা হয়েছিল ‘গণধর্ষণ’। এত বছরেও সেই ঘটনার সঠিক বিচার হয়নি বলে দাবি বালুরঘাটের বাসিন্দা সেই নার্সের পরিবারের। তিন জনের আংশিক শাস্তি হলেও, মূল দোষীরা সাজা পাননি আজও।
আজ থেকে ৪২ বছর আগের সেই ঘটনার সময়েও ঘটনা রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের আনাচকানাচেও ছড়িয়ে পড়েছিল অশান্তির আঁচ। রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সে সময়েও ওই নার্সের পরিবারে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন শাস্তির। ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণও দিয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও সেই সময়ে শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন ওই নার্সের জন্য। কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভতে কেঁদেছিল সে দিনও।
নিহত সেই নার্সের ছোট বোন এখন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি। তিনি জানান, তাঁর বড় দিদি বালুরঘাট থেকে কোচবিহারে এসেছিলেন সরকারি চাকরির জন্য। তিনি মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ হাসপাতালে স্টাফ নার্স হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কোচবিহারের ডাকঘর এলাকায় মেজো দিদি এবং জামাইবাবুর বাড়িতে থাকতেন তিনি। সেখান থেকেই কাজ করতেন হাসপাতালে।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরছিলেন নার্স। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সেদিন প্রায় জলমগ্ন হয়ে গিয়েছিল গোটা এলাকা। তার মধ্যেই হাসপাতাল থেকে বাড়ির উদ্দেশে বেরোলেও, সে রাতে বাড়ি পৌঁছননি তিনি। ঝড়জলের মধ্যে তাঁকে খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাননি বোন ও ভগ্নীপতি। পরের দিন সকালে ওই নার্সকে নগ্ন, অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন প্রতিবেশীরা। পুলিশে খবর দেওয়া হয়। জানা যায়, চরম নির্মমভাবে গণধর্ষণ করা হয় তাঁকে। ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল তাঁর যৌনাঙ্গ। শুধু তাই নয়, তাঁর উপরে অ্যাসিড হামলাও চালানো হয়েছিল। হাসপাতালেরইরাইলস টিউব গলায় দিয়ে তাতে ঢালা হয়েছিল অ্যাসিড, যার ফলে ঝলসে গিয়েছিল গলার ভিতরের অংশ।
এই অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয় বাসিন্দারা। খবর দেওয়া হয় পরিবারকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পরে মৃত্যু হয় নির্যাতিতার। কিছু বলে যাওয়ার সুযোগ পাননি তিনি।
ছোট বোন পূর্ণিমা জানান, ওই ঘটনায় তাঁরা যে শুধু দিদিকে হারিয়েছিলেন তা নয়, তাঁদের গোটা পরিবারও শেষ হয়ে গিয়েছিল। রাজ্যের তরফে ক্ষতিপূরণ মিলেছিল, নির্যাতিতার দাদাকে রাজ্য সরকার চাকরিও দিয়েছিল। কিন্তু বড় মেয়ের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে মারা যান তাঁর বাবা। বাবার আদিবাড়ি কোচবিহারের নিউ টাউনের বুড়িহাটি মসজিদের কাছে হলেও, ছয়ের দশকে চাকরির সূত্রে তিনি বালুরঘাটে চলে এসেছিলেন। চার মেয়ে, তিন ছেলে-- মোট সাত ছেলে-মেয়ে নিয়ে বড় সংসার ছিল তাঁর। বড় মেয়ে বর্ণালী কলকাতা থেকে নার্সিং ট্রেনিং করার পরে, চাকরি করতে গিয়েছিলেন কোচবিহারের হাসপাতালে। সেখানেই সব শেষ হয়ে যায়।
পূর্ণিমার অভিযোগ, তাঁর দিদি প্রতিবাদী ও আপসহীন ছিলেন বলেই চক্রান্ত করে এমন হামলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। মেরে ফেলা হয়েছিল তাঁকে। আজ ৪২ বছর পরেও এই একই অভিযোগের সুর শোনা গেছে আরজি করে খুন হওয়া তরুণী চিকিৎসকের মা-বাবার গলাতেও। পূর্ণিমার বক্তব্য, এই সরকারের আমলে যেমন প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা হচ্ছে, ঠিক তেমনই হয়েছিল সেই সময়েও। সে সময়েও অভিযুক্তরা শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল।
পুলিশি তদন্তের শেষে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয় ওই ঘটনায়। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া খুবই ধীর গতিতে এগোচ্ছিল। শেষে ধৃতদের মধ্যে ৩ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেওয়া হয় ও সাত জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ে পরে ওই তিন জনও জামিন পেয়ে যায়।
এর পরে কেটে গিয়েছে ৪২ বছর। খাস কলকাতা শহরে ঘটে গেছে সেই কোচবিহারের মতোই আরও একটি ঘটনা। কিন্তু বিচারের হিসেবে দুই ঘটনাই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। শূন্য। ওই ঘটনার মিটিং-মিছিল-প্রতিবাদ এতদিনে থিতিয়ে গেছে, সকলে ভুলেও গিয়েছেন সব কিছু। কেবল পরিবারের খাঁ খাঁ করা শূন্যতা আজও পূরণ হয়নি। আরজি কর কাণ্ডের বিচারে যেন এমন ফাঁকি না হয়, এইটুকুই চাইছেন পূর্ণিমা।
ওই সময়ের যন্ত্রণার স্মৃতি আজও বুকে নিয়ে বেড়াতে হচ্ছে ওই নার্সের পরিবারের সকল সদস্যদের। ওই ঘটনায় তিনজন অভিযুক্তের ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড হলেও, মূল অভিযুক্তরা আজও অধরা বলেই পরিবারের দাবি। পরিবারের মতে, আজও সুবিচার পায়নি পরিবার। তাই আরজি করের ঘটনা সামনে আসতেই এবারে অন্তত প্রকৃত দোষীদের শাস্তি হোক বলে দাবি করছে নার্সের পরিবার।