অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত বক্সী।
শেষ আপডেট: 1st October 2024 18:18
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় সরকার গঠনের পর ২০১১ সালে পুরমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন ফিরহাদ হাকিম। মাঝে মাত্র ১০ মাস বাদ দিয়ে টানা প্রায় ১৩ বছর ধরে সেই দফতরের মন্ত্রী ফিরহাদ ওরফে ববি।
তবে কালীঘাটের ঘনিষ্ঠ সূত্রে খবর, ছাব্বিশ সালে বিধানসভা ভোটের দেড় বছর আগে ববিকে পুর দফতর থেকে সরানোর জন্য জোরালো দাবি উঠে গেল দলের শীর্ষ স্তরে।
গত সপ্তাহে ৯ নম্বর ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী। সূত্রের খবর, মেয়র ফিরহাদ হাকিমের ওএসডি কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নাম করে ব্যবসায়ী ও প্রোমোটারদের কাছ থেকে টাকা তুলছেন বলে ‘বক্সীদা’কে সেদিনই জানান ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ। সেই সঙ্গে এও বলেন, তাঁর কাছে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ও অডিও রেকর্ড রয়েছে। তা ছাড়া তৃণমূলের পার্টি অফিস তৈরি করার নামেও টাকা তোলা হয়েছে।
সদ্য লোকসভা ভোটে রাজ্যের পুর এলাকায় তুলনামূলক ভাবে খারাপ ফল করেছে তৃণমূল। সূত্রের দাবি, অভিষেক ও তাঁর অনুগামীরা মনে করেন, এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না পুরমন্ত্রী। তা ছাড়া অভিষেক এ প্রশ্নও তুলেছেন, ববি এতটা কেন ‘প্রিভিলেজড’? কেন সব মন্ত্রীর দফতর বদল হলেও ববি হাকিমের হয় না? তৃণমূলের ওই সূত্রের মতে, অভিষেকের যুক্তি খণ্ডন করতে পারেননি রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীও।
সুব্রত বক্সীর সঙ্গে আলোচনার পর এ ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও কথা হয়েছে অভিষেকের। কালীঘাটের ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে, কালীচরণের বিরুদ্ধে তাঁর কাছে যে তথ্য প্রমাণ রয়েছে তা দিদিকেও জানিয়েছেন অভিষেক। তা ছাড়া এও জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর নাম করে কেউ টাকা তুললে তিনি কোনওভাবেই বরদাস্ত করবেন না।
তবে অভিষেকের ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, মনে রাখতে হবে দুটি বিষয় বিচ্ছিন্ন। পুরমন্ত্রী পদে কেউ একটানা ১৩ বছর থাকবেন কিনা, এক ব্যক্তি দুটি পদে থাকবেন কিনা তা নীতিগত বিষয়। এ ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই একমাত্র সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার রয়েছে। আর দুর্নীতির অভিযোগ আর একটি বিষয়। ফিরহাদের সঙ্গে অভিষেকের সম্পর্কে গতিশীলতা কীরকম, তার নিক্তিতে যেন দুর্নীতির অভিযোগকে মাপা না হয়। এখানে অভিযোগ গুরুতর।
জানা গিয়েছে, দলের মধ্যে এই ঢেউ তুলে দিয়ে সোমবার অনেক রাতে চিকিৎসার জন্য বিমান ধরেছেন অভিষেক। চিকিৎসার কারণেই সম্ভবত এই বিদেশযাত্রা। এবং সে জন্য বুধবার 'জাগো বাংলা'র শারদ সংখ্যার উদ্বোধনেও অভিষেক থাকবেন না।
এগারো সালে তৃণমূল সরকার গঠনের পর মন্ত্রিসভার উল্লেখযোগ্য মুখ ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, ব্রাত্য বসু। এর মধ্যে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম ও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক একটানা দশ বছর একই দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। সুব্রতবাবু ছিলেন পঞ্চায়েত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী। তবে আঠারো সালে পঞ্চায়েত ভোটের পর জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর তাঁর হাত থেকে চলে যায়। কিন্তু পঞ্চায়েত থেকে যায়। জ্যোতিপ্রিয় খাদ্য ও ফিরহাদ হাকিম পুরমন্ত্রী ছিলেন। একুশ সালে বিধানসভা ভোটের পর জ্যোতিপ্রিয় তথা বালুকে খাদ্য থেকে বন দফতরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফিরহাদ হাকিমকে দেওয়া হয় পরিবহণ ও আবাসন দফতর। কিন্তু ১০ মাসের মধ্যে পুর দফতরে ফিরে আসেন ফিরহাদ হাকিম।
বাংলায় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় পুরমন্ত্রী ছিলেন শিলিগুড়ির সিপিএম নেতা ও বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে ১৫ বছর পুরমন্ত্রী ছিলেন অশোকবাবু। কিন্তু তৃণমূলের মধ্যেই এখন প্রশ্ন উঠেছে, পুরমন্ত্রী হিসাবে অশোক ভট্টাচার্যের যে গতিশীলতা ছিল, তার ধারেকাছেও কি পৌঁছতে পেরেছেন ববি হাকিম? পুরমন্ত্রী হিসাবে শেষ কবে জেলা সফরে গিয়েছেন তিনি? শেষ কবে জেলার পুরসভা ধরে ধরে বৈঠক করেছেন? ‘মেয়রকে বলো’ ছাড়া নতুন কোন প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়েছে তাঁর হাত দিয়ে?
এখানে জানিয়ে রাখা ভাল যে, কাকে কোন দফতরের মন্ত্রী করা হবে, তা মুখ্যমন্ত্রীর অগ্রাধিকার। তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। পুরমন্ত্রী হিসাবে ববির পারফরমেন্স নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে (পড়ুন, ঝড়ের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে), তার মানে এই নয় যে তাঁর দফতর বদল অবশ্যম্ভাবী। তবে হ্যাঁ, এ ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই যে ববিকে পুরমন্ত্রীর পদ থেকে সরানোর ব্যাপারে দলের মধ্যে একটা সহমত গড়ে তোলার প্রয়াস শুরু হয়েছে।
তৃণমূল সূত্রের দাবি, গত ৭২ ঘণ্টায় এ ব্যাপারে দুটি বৈঠক খুব প্রাসঙ্গিক। এক, দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর বৈঠক। এবং দুই, শুক্রবার সন্ধেয় কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে আলোচনা।
তাৎপর্যপূর্ণ হল, সেই পর্বে ফিরহাদ হাকিম, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত বক্সীর একটা অলিখিত জোট দেখা গেছিল। অচলায়তন ভাঙার চেষ্টার বিরুদ্ধে প্রাচীর হিসাবে দেখা হচ্ছিল তাকে। কিন্তু পার্থ এখন জেলে। সুব্রত বক্সীর নিজস্ব কোনও অবস্থান নেই। দিদির অবস্থানই তাঁর অবস্থান।
ফলে নতুন করে যে ঝড় উঠতে শুরু করেছে সেখানে বট গাছতলায় একা দাঁড়িয়ে ফিরহাদ হাকিম। আর শেষ আশ্রয় বলতে দিদি।