মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ আপডেট: 5th October 2024 08:43
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
আরজি করের ঘটনার পর অনেকেই দাবি তুলেছিল, এবার পুজোয় সরকারি অনুদান বয়কট করা হোক। কেউ কেউ মনে করেন, সেই দাবি তোলার নেপথ্যে বামপন্থী কিছু সংগঠন ও বিজেপির প্রভাব ছিল। তা ছাড়া শুরুতে একটা-দুটো পুজো কমিটি আনুষ্ঠানিক ভাবে বয়কটের কথা ঘোষণা করার পর সংবাদমাধ্যমেও তা বহুল প্রচার পেয়েছিল।
অথচ দিনের শেষে দেখা গেল, এই বয়কটের ডাক শেষমেশ কোনও প্রভাব ফেলতে পারল না। নবান্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য পুলিশ এলাকায় ৪১,৮৮৯টি পুজো কমিটি সরকারি অনুদানের জন্য আবেদন করেছিল। তার মধ্যে ৪০,৬৫৫টি পুজো কমিটি চেক পেয়ে গিয়েছে। বাকিরাও আজকালের মধ্যে চেক পেয়ে যাবে।
এখানে তিনটি বিষয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এক, গত বার বা তার আগেও যারা অনুদান নিয়েছে এমন মাত্র ৫৯টি পুজো কমিটি এবার সরকারি চাঁদা নেয়নি, তথা ফিরিয়ে দিয়েছে। যা কার্যত কোনও শতাংশের হিসাবেও আসছে না।
দুই, রাজ্য পুলিশের এডিজি আইনশৃঙ্খলা জানিয়েছেন, গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ২ হাজার বেশি আবেদন জমা পড়েছে। অর্থাৎ সবকটি জেলা মিলিয়ে গত বছর পুজোর অনুদান চেয়ে চল্লিশ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। এবার তার চেয়ে প্রায় ২ হাজার বেশি আবেদন জমা পড়েছে।
এবং তিন, বহু পুলিশ জেলায় একটিও পুজো কমিটি সরকারি অনুদানে ‘না’ বলেনি।
যেমন, বনগাঁ, বসিরহাট, ডায়মন্ড হারবার, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া গ্রামীণ, জঙ্গিপুর, পূর্ব বর্ধমান, হুগলি গ্রামীণ, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, রায়গঞ্জ, ইসলামপুর, দার্জিলিং, কালিম্পং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার পুলিশ জেলায় সরকারি অনুদান ফেরায়নি কোনও পুজো কমিটি। বীরভূম জেলাতেও সবকটি পুজো কমিটি সরকারের অনুদানের জন্য আবেদন করেছে।
কৌতূহল হতে পারে, যারা সরকারি অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছে তারা কারা? কোন এলাকায় বয়কট সবচেয়ে বেশি হয়েছে। রাজ্য পুলিশের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, বিধাননগর পুলিশ জেলা এলাকায় এই সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশি। গোটা রাজ্যে যে ৫৯টি পুজো কমিটি সরকারি অনুদান ফিরিয়ে দিয়েছে তার মধ্যে ২৫টিই বিধাননগর পুলিশ জেলা এলাকায়।
পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, বিধাননগর এলাকায় বহু পুজো কমিটির মাথায় রয়েছেন অবাঙালিরা। বিজেপির প্রভাব ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এখানে তুলনামূলক ভাবে বেশি। এবার লোকসভা ভোটেও বিধাননগরে তৃণমূলের সঙ্গে প্রায় সমান ভোট পেয়েছে বিজেপি।
অথচ ঘটনা হল, বিধাননগর এলাকার এই প্রতিবাদের কোনও প্রভাব নেই পাশের পুলিশ জেলা ব্যারাকপুরে। সেখানে মাত্র দুটি পুজো কমিটি সরকারি অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছে। আবেদনের সংখ্যা মোট ২৪৬৫।
বিধাননগরের পরই রয়েছে চন্দননগর পুলিশ জেলা। সেখানে ৯টি পুজো কমিটি সরকারের অনুদান নিতে চায়নি। ঘটনা হল, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর জেলায় প্রায় ১৩০০ পুজো কমিটি অনুদান পেয়েছে, সরকারি চাঁদা ফিরিয়ে দিয়েছে মাত্র ৪টি পুজো কমিটি।
পুজোর অনুদানের জন্য সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়েছিল পূর্ব বর্ধমান জেলায়। মোট ৩৯৩৬। তারা সবাই অনুদান মূল্য তথা ৮৫ হাজার টাকা করে চেক পেয়েও গেছে।
এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে রাজ্য সিপিএমের রাজ্য নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “সিপিএম কাউকে টাকা ফেরত দিতে বলেনি। পুজো বন্ধ করতেও বলেনি। কিছু অপদার্থ রয়েছে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ সব করে”। সুজন চক্রবর্তী আরও বলেন, “সরকার যখন এই প্রকল্প শুরু করেছিল, তার আগে কোনও পুজো কমিটি বলেনি যে আমাদের টাকা নেই পুজো করতে পারছি না। সরকার ভোট ব্যাঙ্কের কথা ভেবেই এটা শুরু করেছিল।” এই বাম নেতার দাবি, “যাঁরা চাঁদা ফিরিয়েছেন তাঁদের উপর নানা ভাবে চাপ তৈরির চেষ্টা চলছে বলে শুনেছি। নইলে হয়তো আরও অনেকে টাকা নিত না।”
আবার শাসক দল এই পরিসংখ্যান দেখে স্বস্তিতে। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের কথায়, “আরজি করের ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদ ছিল স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। ওই জঘন্য ঘটনার নিন্দা তৃণমূলও করেছে। কিন্তু বাম-বিজেপি এই ঘটনাকে সামনে রেখে পুজোর অনুদান ও লক্ষ্ণীর ভাণ্ডার বয়কটের ডাক দিয়ে যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করেছিল, তা ভেস্তে দিয়েছে বাংলার মানুষ। পরিসংখ্যানেই তা পরিষ্কার”।
পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, এই পরিসংখ্যানের দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, আরজি করের ঘটনা গ্রামে কতটা প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে শাসক দলের উৎকন্ঠা হয়তো ছিল। এই পরিসংখ্যান তাদের স্বস্তি দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, অনেকেই আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদের সঙ্গে দুর্গা পুজোর উৎসবকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। প্রতিবাদ করলেই উৎসব করা যাবে না এমন নয়। বা উৎসবে রয়েছে মানে মনে প্রতিবাদের আগুন নেই, তেমনও নয়। কিন্তু বয়কটের হিড়িক তোলার নেপথ্যে কোথাও কোথাও রাজনৈতিক প্রয়াসও ছিল। সেটার কোনও প্রভাব দেখা গেল না।