বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
শেষ আপডেট: 4th August 2024 15:52
রেডিও থেকে ভেসে আসছে 'আশ্বিনের শারদ প্রাতে, বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত, জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা৷' যাঁর কণ্ঠ দিয়ে হয় শারদপূজার এই আচমন, আজ তাঁর জন্মদিবস। বিরূপাক্ষ ওরফে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendrakrishna Bhadra)।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর কন্ঠের জনপ্রিয়তার কারণে বেতারের অনুষ্ঠানকেই ‘মহালয়া’ বলে ভুল করেন অনেকে। আসলে ‘মহালয়া’ একটি তিথি। অনুষ্ঠানটির নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে তাঁর গম্ভীর কণ্ঠে স্তোত্রপাঠ দিয়েই শুরু হয় আনন্দময়ী মহামায়ার আগমনী। আকাশবাণী কলকাতার প্রভাতী অনুষ্ঠান 'মহিষাসুরমর্দিনী' দিয়েই শুরু হয় মহালয়ার ভোর। বিরূপাক্ষর কণ্ঠ বেজে ওঠে ঘরে ঘরে।
১৯০৫ সালের ৪ অগস্ট উত্তর কলকাতায় মামারবাড়িতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম হয়। পিতা ছিলেন রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র ও মাতা ছিলেন সরলাবালা দেবী। কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন বহুভাষাবিদ, তিনি ১৪টি ভাষা জানতেন। পরবর্তীকালে ঠাকুমা যোগমায়া দেবীর সঞ্চিত টাকায় ক্রয় করা ৭, রামধন মিত্র লেনে উঠে আসেন তাঁদের পরিবার। পাঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানির প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তাঁর ঠাকুমা যোগমায়া। তিনি ছিলেন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা উচ্চশিক্ষিতা মহিলা। ইংরেজি, সংস্কৃত জানতেন। ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃতের প্রথম হাতখড়ি বীরেন্দ্রর।
১৯২৮ সালে বিএ পাশ করে বাবার বন্ধুর সুপারিশে যোগ দেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে। দুপুরে টিফিনের বিরতি বা বিকেলের অবসরে চলে আসতেন রেডিওর অনুষ্ঠানে। যেখানেই যেতেন, আসর জমিয়ে দিতে পারতেন। তাঁর এই গুণেই মোহিত হয়ে নৃপেন মজুমদার তাঁকে আহ্বান জানালেন রেডিওতে। চাকরি ছেড়ে যোগ দিলেন রেডিওয়, ১৯২৮-এর শেষের দিকে। রেডিওর জগতেই কেটে গেল তাঁর জীবন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আলো-আঁধারিতে।
শুরুতে ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শুরু করলেন ‘মহিলা মজলিশ’। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বীরেন্দ্রর কণ্ঠ জনপ্রিয় হয়ে উঠল মহিলা মহলে। ১৯৩০-এর দশকের এই সময় থেকেই দুর্গাপুজো উপলক্ষে দেবী দুর্গার পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে দু'ঘণ্টার সঙ্গীতালেখ্য মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। এই অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা করেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ করেন। প্রথমে লাইভ অনুষ্ঠান হত, তার পর থেকে রেকর্ড বাজানো হয়।
১৯৩২-এর ষষ্ঠীর ভোরে প্রথম বার প্রচারিত হয় বেতারের কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী। পরে এটি মহালয়া তিথিতে পরিবর্তিত করা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর গম্ভীর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ আজও শুধু মহালয়া নয় সারা পুজোর ইউএসপি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর চণ্ডীপাঠ শোনার সময়ে আমাদের সকলের উপলদ্ধি হয় একসময় তাঁর গলা ধরে আসে ক্রন্দনরত হয়ে পড়েন তিনি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বলতেন এর কারণ হল তিনি সামনে তখন মা দুর্গাকে দেখতে পান।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আকাশবাণীর প্রধানও ছিলেন। বীরেনদা ব্যতীত আকাশবাণী আজও ভাবতে পারেন না তাঁর সহকর্মীরা। বহু নাটকের প্রোডাকশন ছিল তাঁর। যাতে গলা দিতেন ছবি বিশ্বাস থেকে অহীন্দ্র চৌধুরী। বিকাশ রায়ের প্রতিভা বীরেন ভদ্রই প্রথম আবিস্কার করেন। তিনিই বলেন "বিকাশ সিনেমায় চেষ্টা করো, তোমার হবে।"
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ (Birendrakrishna Bhadra) 'মেস নং ৪৯'-সহ একাধিক নাটক রচনা করেন। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, মাইকেল মধুসূদন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শচীন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখ নাট্যকারের বিখ্যাত নাটক বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রযোজনায় বেতারস্থ হয়েছে। অনেক নাটক পেশাদারি মঞ্চের চেয়েও বেতারে বেশি সফল হয়েছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ডাকেই তখনকার রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত শিল্পীরা নাটক করেছিলেন বেতারে। তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘চন্দ্রগুপ্ত’।
বিমল মিত্রের 'সাহেব বিবি গোলাম' উপন্যাসটিকে তিনি মঞ্চায়িত করেছিলেন। ১৯৫২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সুবর্ণ গোলক গল্পটিকেও তিনি নাট্যায়িত করেন। তাঁর জুনিয়ররা জগন্নাথ বসু থেকে শ্রাবন্তী মজুমদাররা বীরেনদার স্মৃতিতে আজও সেই সময়টাতে ফিরে যান। বীরেন ভদ্র বলতেন নতুনদের, "যেটা রেডিওয় বলছো সেটা যতক্ষণ না আত্মস্থ করতে পারবে, ততক্ষণ সেটা শ্রোতার মনে রেখাপাত করবে না।"
আকাশবাণী কলকাতা থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা লাইভ অনুষ্ঠান করে শোনান সারা বাংলাকে। যেমন ১৯৪১ সালের ৭ অগস্ট। ২২শে শ্রাবণ। অঝোর বৃষ্টিস্নাত দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শরীর অত্যন্ত খারাপের দিকে। আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের নির্দেশ, সকাল থেকে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর কবিগুরুর খবর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
নলিনীকান্ত সরকার গেলেন জোড়াসাঁকো। সেখান থেকে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ফোন করে পাঠালেন রবি ঠাকুরের খবর। আর সেই সূত্র ধরে রেডিও অফিস থেকে ১৫ মিনিট অন্তর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ঘোষণা করে চললেন দুপুর পর্যন্ত। বেলা বারোটা তেরো মিনিটে গুরুদেব অনন্তলোকে যাত্রা করলেন। বেতার কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন, শ্মশানক্ষেত্র থেকে অনুষ্ঠানাদি সম্প্রচার করা হবে। কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির শেষযাত্রার ধারাবিবরণী রেডিওয় সেই প্রথম।
বীরন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের (Birendrakrishna Bhadra) অশ্রুসিক্ত কণ্ঠ ভেসে এল রেডিও থেকে। “ঠাকুরবাড়িতে বেশিক্ষণ শবদেহ রাখার রীতি নেই, বিশেষত মধ্যাহ্নে যিনি প্রয়াণ করেছেন বিকেলের মধ্যে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করতেই হবে। সংবাদ সংগ্রহ করতে করতে আমরাও নিমতলা শ্মশানে এসে হাজির। ও-পারে দূরের ওই নীলাকাশে অস্তগামী সূর্য শেষ বিদায়ের ক্ষণে পশ্চিম দিগন্তে ছড়িয়ে দিল অগ্নিবর্ণ রক্তিম আভা, আর এপারে এই পৃথিবীর বুকে বহ্নিমান চিতার লেলিহান অগ্নিশিখায় পঞ্চভূতে বিলীন হল এক মহপ্রাণের পূত-পবিত্র শরীর। রবি গেল অস্তাচলে..."
রবি ঠাকুরের মৃত্যুর খবর পেয়ে সেদিন ঐ ঘোর বর্ষার দিনে একজন সদ্যকিশোর ছুটেছিল রাস্তায়। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন কবিগুরুর শেষযাত্রা। সেই কিশোরটি ছিল উত্তম কুমার। কিন্তু সেদিন কি সে-ও জানত, যে কয়েক দশক পরে তার প্রয়াণের খবরও ধারাভাষ্য-রূপে একই ভাবে পড়বেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র! আর একই রকম জনজোয়ার রাস্তায় নামবে!
২৫শে জুলাই ১৯৮০। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। মহানায়কের প্রয়াণে জনতার মহামিছিল। অন্তিম যাত্রার চলমান শোকমিছিল কলকাতাবাসী প্রথম দেখেছিল ৭ই অগস্ট (বাংলার ২২ শ্রাবণ), ১৯৪১ সালে। এর পরে দ্বিতীয় ও শেষবার দেখলেন মহানায়কের মহাপ্রয়াণে। উত্তমকুমারের মৃত্যুর দিন তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendrakrishna Bhadra) ক্যাওড়াতলা শ্মশানে তাঁর ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন। উত্তমকুমারের শরীরে যখন আগুন ছোঁয়ানো হল, ক্ষণিকের জন্য থেমে গেলেন তিনি। চোখটা চিকচিক করে উঠল।
তার পরে তাঁর সেই চিরাচরিত কণ্ঠে বলে যেতে লাগলেন, “যে সুন্দর কমনীয় শরীর মুখমন্ডল এতকাল তাঁর অজস্র ভক্তকে আনন্দ দিয়েছে, সেই শরীরে আগুন স্পর্শ করল। ছোঁয়ালেন তাঁর প্রিয়তম পুত্র গৌতম। মহানায়কের নশ্বরদেহ ঘিরে এখন আগুনের লেলিহান শিখা। একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে তাঁর শরীরকে। আমি দেখতে পাচ্ছি, কাতারে কাতারে মানুষ এসে একবার পাদপদ্ম স্পর্শ করতে চাইছে” – মহানায়ক উত্তমকুমারকে ঘিরে সাধারণ মানুষের আবেগকে কী অনায়াসে বীরেন ভদ্র নিজ কণ্ঠের দ্বারা বিহ্বল করে তোলেন রেডিওর তরঙ্গে।
বেতারে ‘রূপ ও রঙ্গ’র আসরে ‘বিরূপাক্ষ’ ছদ্মনামে নিজের লেখা কৌতুক-নকশা পরিবেশন করেছিলেন বীরেন (Birendrakrishna Bhadra)। ‘বিরূপাক্ষের ঝঞ্ঝাট’, ‘বিরূপাক্ষের বিষম বিপদ’, ‘বিরূপাক্ষের অযাচিত উপদেশ’ বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র রেডিওর জন্য যা করেছেন যা দিয়েছেন তাঁর পরিবর্তে তিনি ও তাঁর পরিবার রেডিও থেকে সেরকম কিছু পাননি। পেয়েছেন আজীবন জনতার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। কিন্তু এই কিংবদন্তি বাঙালির আরও অনেক বেশি কিছু প্রাপ্য ছিল।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখের অন্তিমযাত্রার বিবরণও দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ (Birendrakrishna Bhadra)। এর পরে ১৯৯১ সালের ৪ নভেম্বর তিনি নিজেই অমৃতলোকে যাত্রা করেন। তাঁর শেষযাত্রা আড়ম্বরহীন হয়েছিল, যা তাঁর প্রাপ্য ছিলনা। আসলে তাঁকে তো মানুষ কণ্ঠ দিয়েই চিনত। শেষ জীবনে হতাশা ও স্মৃতিভ্রংশতা গ্রাস করেছিল। একটা কথা প্রায়ই বলতেন, "এখন আর আমায় কেউ মনে রাখে না, কিন্তু বছরে একটা দিন তাঁরা আমায় ছাড়া ভাবতে পারে না। সেদিনটা মহালয়া।"