কলকাতায় চিকিৎসা করাতে এসে রহস্যজনকভাবে খুন হলেন বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাংসদ আনোয়ারুল আজিম।
শেষ আপডেট: 22nd May 2024 16:21
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ঘটনাটা সব অর্থেই বেনজির। শেষ কবে এরকম হয়েছে, পুলিশের দুঁদে কর্তারাও মনে করতে পারছেন না। কলকাতায় চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন বাংলাদেশের ঝিনাইদহের বাসিন্দা আনোয়ারুল আজিম আনার। যেমন বাংলাদেশের অনেকেই নিয়মিত আসেন। এপার-ওপার মিলিয়ে দুই দেশের আত্মীয়তা কম নয়। অনেকেই বাংলাদেশ থেকে কলকাতা এলে ওঠেন পরিচিতজনের বাড়িতে। আনোয়ারুলও গত ১২ মে এসে উঠেছিলেন বরানগরে বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। পরেরদিন ১৩ মে দুপুর পৌনে দু'টো নাগাদ ডাক্তার দেখাবেন বলে বেরোন। বলেন, সন্ধ্যেবেলা ফিরে আসবেন। দুপুরে খাওয়াটা আর হবে না। অথচ সন্ধ্যে হলেও আর ফেরেননি আনোয়ারুল। হোয়াটসঅ্যাপ করে জানান, তিনি এক বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছেন! ফোন করার দরকার নেই। দু'দিন পর ১৫ মে, সকাল সাড়ে এগারোটায় গোপালকে আবার মেসেজ করেন আনোয়ারুল। বলেন, তিনি দিল্লি পৌঁছলেন। সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, তাই ফোন করার দরকার নেই। ওই একই মেসেজ তিনি পাঠান তাঁর বাড়িতে ও ব্যক্তিগত সচিবকেও।
সন্দেহ করেননি গোপাল। কারণ আনোয়ারুল আজিম আনার তো সাধারণ কেউ নন। তিনি বাংলাদেশের ঝিনাইদহ-৪ আসনে তিনবারের সাংসদ। পাশাপাশি, কালীগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামি লিগের সভাপতি।
দুইবার একইভাবে 'ফোন যেন না করা হয়' বার্তাতেও কিছু মনে হয়নি গোপালের। হতেই পারে এরকম। কিন্তু দিনদুয়েক পরে ১৭ মে সাংসদের মেয়ে ফোন করে জানান, তিনি কিছুতেই বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। এতেই নড়েচড়ে বসেন গোপাল। খোঁজখবর করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনওভাবেই সাংসদের ফোনে সাড়া পাওয়া যায়নি। ততদিনে পেরিয়ে গিয়েছে পাঁচদিন। আর কালবিলম্ব করেননি গোপাল। পরেরদিন ১৮ মে সটান হাজির হ'ন বরানগর থানায়।
বি টি রোড সংলগ্ন সিঁথি অঞ্চলের মণ্ডলপাড়া লেনের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে প্রায় ২০-২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল সাংসদ আনোয়ারুল আজিমের। এককালে বিএনপির আমলে নিরাপত্তাজনিত কারণে ভারতে চলে এসেছিলেন আনোয়ারুল। নদিয়ার মাজদিয়ায় সুভাষ আগরওয়ালের বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। সেখানেই গোপালের সঙ্গে আলাপ। পরে সেই আলাপ গড়ায় গভীর বন্ধুত্বে। গয়না রফতানির ব্যবসা আছে গোপালের। পুলিশের কাছে তিনি বিস্তারিত তথ্য দিয়ে নিখোঁজ ডায়রি করেন। ওদিকে বাবার সন্ধান না মেলায় উদ্বিগ্ন আজিমের কন্যা মুমতারিন ফিরদৌস ডরিন সটান হাজির হ'ন ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। ঘটনার বিবরণ শুনে নড়েচড়ে বসেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অফিসাররা। যোগাযোগ করা হয় ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের সঙ্গে। কলকাতার বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের তরফেও লালবাজারে খবর দেওয়া হয়। তড়িঘড়ি তদন্তে নামেন কলকাতা পুলিশের একাধিক উচ্চপদস্থ আধিকারিক। ওদিকে মুমতারিন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাবিভাগেও অভিযোগ দায়ের করেন। সূত্রের খোঁজে তল্লাশি শুরু করে ঢাকা পুলিশ। ভারতীয় পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতায় আনোয়ারুলের মোবাইল ফোনের সিম ট্র্যাক করতে দেখা যায়, সেটি বিহারের কাছাকাছি কোথাও রয়েছে। দিল্লি যাওয়ার কথা বলে বিহারে কী করছেন আনোয়ারুল? সন্দেহ ঘনীভূত হয় পুলিশের।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা এদিকে তদন্তে নেমে প্রথমেই আনোয়ারুল গোপালের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে গাড়িতে উঠেছিলেন, তার চালককে খুঁজে বের করেন। জিজ্ঞাসাবাদে চালক জানান, আনোয়ারুল গাড়িতে ওঠার পরে আরও তিনজন সেই গাড়িতে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দু'জন পুরুষ ও একজন মহিলা। চারজনকে নিয়ে গাড়ি নিউ টাউনের একটি বিলাসবহুল আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেন্সের সামনে নামিয়ে দেয়। খবর যায় বিধাননগর কমিশনারেটে। আসরে নামেন সন্ত্রাসদমন শাখার অফিসাররা। সঞ্জীবা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটকে চিহ্নিত করে ফেলে পুলিশ। তাতেই চক্ষু চড়কগাছ হবার জোগাড়! বিভিন্ন সূত্রের খবর, ফ্ল্যাটে রক্তের দাগ-সহ নানা মারাত্মক তথ্যপ্রমাণ ছিল! বোঝা যায়, নিখোঁজ নন, খুন হয়েছেন আনোয়ারুল।
ফ্ল্যাটের বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখতে শুরু করে পুলিশ। সন্দেহ হয় আনোয়ারুলের গাড়িতে ওঠা তিন ব্যক্তিদের নিয়ে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশ, দেখা যায়, আলাদা ভাবে তিনজন ওই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসছে। একজন বেরোচ্ছেন ১৫ মে, একজন ১৬ মে, শেষজন ১৭ মে। কিন্তু তাহলে কবে খুন হয়েছেন আনোয়ারুল? যদি ১৩ মে-ই তাঁকে খুন করা হয়, তাহলে আততায়ীরা পরের তিনদিন সেখানে কী করছিল? খুনের পর অকুস্থল ছেড়ে পালানোটাই যেখানে চালু রীতি! পরে দেখা যায়, আনোয়ারুলের গাড়িতে ওঠা সঙ্গী দুই পুরুষ আদতে বাংলাদেশের বাসিন্দা। তাঁরা বাংলাদেশে ফিরে যান তারপর। ততদিনে ঘটনাটি নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। সূত্র মারফৎ খবর পেয়ে সেই দু'জনকে ধরে ফেলে বাংলাদেশের পুলিশকর্তারা। শুরু হয় জেরা। তখনই বোঝা যায়, সম্ভবত বেঁচে নেই সাংসদ। তাঁকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে।
তদন্তের স্বার্থে আটক ব্যক্তিদের নিয়ে কিছুই জানাতে চায়নি ঢাকা। মহানগর পুলিশের গোয়েন্দাবিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মহম্মদ হারুন-অল রশিদ যেমন সাংবাদিক বৈঠকে জানান, ‘একজন সংসদ সদস্যকে যেভাবে বাংলাদেশের কিছু অপরাধী নৃশংসভাবে যেভাবে হত্যা করেছে, আমরা তাঁদের কয়েকজনকে আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি। তদন্তের স্বার্থে আমরা আটক ব্যক্তিদের নাম বলছি না।' কিন্তু পুলিশকর্তারা মুখে কুলুপ আঁটলেও, বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, নিউ টাউনের বিলাসবহুল আবাসন থেকে কোনও দেহ পাওয়া যায়নি। কলকাতা পুলিশ এই তথ্য জানিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাসে। ওদিকে সন্দেহভাজন বলে দু'জনকে আটক করেছেন বিধাননগর কমিশনারেটের কর্তারা।
রহস্য অতএব এখনও ঘনীভূত। অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব নেই। মোটামুটিভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, আনোয়ারুল আজিমের মোবাইল থেকে আসা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আদতে অপরাধীরাই পাঠিয়েছে। দিল্লি যাওয়ার তথ্যের মধ্যেই বিভ্রান্তি ছড়ানোর মোটিভ স্পষ্ট। সম্ভবত আনোয়ারুলের সিম কার্ড নিয়ে অপরাধীদের কেউ বিহার পালিয়ে গিয়েছে। তাহলে বাংলাদেশী নাগরিকদের সঙ্গে নিশ্চিতভাবেই জড়িত রয়েছে আরও অন্য কেউ। তাহলে কি ১৩ তারিখ রাতের মধ্যেই খুন হয়েছেন আনোয়ারুল? যদি তাই হয়, তাহলে আততায়ীরা অতদিন ফ্ল্যাটে রইল কেন? দেহ কোথায় লোপাট হল? সবচেয়ে বড় কথা, খুনের পিছনে কারণটাই বা কী? যে মহিলা ছিলেন গাড়িতে, তিনি কে? ডাক্তার দেখানোর কথা বলে তাঁদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় নিউ টাউনের আবাসনে গেলেন কেন আনোয়ারুল?
তদন্ত শেষ না হলে অবশ্য এই প্রশ্নগুলোর জবাব মিলবে না।