শেষ আপডেট: 11 February 2024 14:30
অমল সরকার
ভারতরত্ন সম্মান প্রদানের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে গত রবিবার (৪ ডিসেম্বর) লিখেছিলাম। বলার চেষ্টা করেছিলাম, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় নাম জড়ানো, মন্দির-মসজিদ বিবাদের রাজনীতির কান্ডারি লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো মানুষকে ‘ভারতরত্ন’ ঘোষণা করে সরকার এই সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানের অবমাননা করেছে। সেই লেখায়, এই আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলাম, এরপর হয়তো বাবরি ধ্বংসের কলঙ্কময় ঘটনায় দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় থেকে অতিসক্রিয় ভূমিকা পালনকারী প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও-কেও মরণোত্তর এই সম্মান প্রদান করা হবে। আরও উল্লেখ করেছিলাম, এই মুহূর্তে দেশে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ভারতরত্ন পাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।
নরসিংহ রাওকে নিয়ে আমার আশঙ্কা যে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বাস্তবে প্রতিফলিত হবে তা কল্পনার অতীত ছিল। এ বছর এখনও পর্যন্ত পাঁচজনের নাম তিন দফায় এই সম্মানের জন্য ঘোষিত হয়েছে। তালিকায় দাড়ি টানা হয়েছে কি না বলা মুশকিল।
এমন সময় নরেন্দ্র মোদী রাজ্যসভায় যে ভাষায় পূর্বসূরি মনমোহন সিংহের প্রশংসা করেছেন, আমার বিশ্বাস সুযোগ পেলে আগামী দিনে রাজনীতির মোড় ঘোরানো অর্থনীতির এই পণ্ডিত-কেও সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানের জন্য বেছে নেবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। সেটা শুধু যোগ্য ব্যক্তিকে সম্মান প্রদানের কারণেই নয়, সেই সূত্রে আরও একবার নরেন্দ্র মোদী বোঝাতে পারবেন, তিনি কংগ্রেস মুক্ত ভারত চান বটে, কিন্তু গান্ধী পরিবারের দ্বারা বঞ্চিত, অসম্মানিত কংগ্রেসিদের তিনি প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছেন। আবারও বলতে পারবেন, মনমোহন সিংহের সরকারকে কীভাবে সনিয়া গান্ধী রিমোট কন্ট্রোলে চালিত করতেন, ইত্যাদি। প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে তো এই ব্যাপারে বিজেপির নয়া সেনা হিসাবে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন।
এই অভিযোগ অসত্য নয় যে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সনিয়া এবং গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠরা প্রণব মুখোপাধ্যায়কে দু-দু’বার প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি। শেষ জীবনে রাষ্ট্রপতি করে রাষ্ট্রীয় বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার আক্ষেপ, অভিযোগ শরদ পাওয়ারেরও আছে। তাই বলে এমন অভিযোগ কি নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে বিজেপিতে নেই? অবশ্যই আছে।
আসলে, অবিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের ‘ভারতরত্ন’ ঘোষণা মোটেই নরেন্দ্র মোদীর উদারতা নয়, বরং অবিজেপি দলের রত্নসম নেতাদের সম্মান জানিয়ে ভোটের বাজারে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মানের চৈত্র সেল শুরু করেছেন। এর কারণ বুঝতে রাজনীতির পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। স্বাধীনতার আগে ও পরে, বিজেপি-সহ গেরুয়া শিবিরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতো হাতে গোনা কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়ার যোগ্য নেতার অভাব গোপন নেই। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলকে দিয়ে শুরু করে বিজেপি এখন কংগ্রেসের প্রাতঃস্মরণীয় নেতাদের নিজের করে নিতে চাইছে। নেহরু-গান্ধী পরিবারের দ্বারা অবহেলিতরা তাতে প্রাধান্য পাবেন, সেটাও স্পষ্ট। মোদী দিল্লিতে টিকে গেলে নিজের দল গড়া কংগ্রেসের প্রাক্তন নেতা-নেত্রীদেরও আগামী দিনে এই সম্মান মেলা অসম্ভব নয়। লক্ষণীয়, দেশ দখলে মোদী-শাহ জুটির আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের কর্মসূচিতেও রাষ্ট্রীয় সম্মান বিলি অন্যতম কৌশল।
আসলে নেতা, নীতির কোনও কপিরাইট হয় না। অসমের প্রয়াত কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, উত্তর প্রদেশে মুলায়ম সিং যাদব, মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ারদের মোদী সরকারই ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মানজ্ঞাপন করেছে। একই কারণে বাংলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নাম বিবেচনা করা হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতে পদ্ম ফোটাতে বিজেপি এনটি রামারাও, জি রামচন্দ্রনের মতো আঞ্চলিক মুখ এবং কে কামরাজের মতো একদা ভারতখ্যাত কংগ্রেস নেতার ছবি, কাটআউট নিজেদের মঞ্চে রাখছে।
নরসিংহ রাও-কে নিয়ে শনিবার রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গোয়েল সঠিক কথাই বলেছেন, ‘কংগ্রেস দলের এই প্রাক্তন সভাপতি তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁকে প্রাপ্য সম্মানটুকু জানায়নি। দলীয় দফতরে দেহ নিয়ে যাওয়া হয়নি।’ এমনকী দিল্লিতে দাহ করার অনুমতিটুকুও মেলেনি। অথচ, কেন্দ্রে তখন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, যিনি রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী থাকাকালে দেশকে নতুন পথে চালিত করেছিলেন। বলাইবাহুল্য রাওকে নিয়ে সেই সিদ্ধান্তে সায় ছিল না মনমোহনের।
রাওয়ের দেহ দাহ করা হয়েছিল নিজের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে। সেখানেও তখন কংগ্রেসের সরকার। সরকারি উদ্যোগে দাহ কাজ করা হলেও মাঝপথে শ্মশান ঘাট ছেড়ে যান সরকারি লোকেরা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর আধ পোড়া দেহের অংশ কুকুরে টানাটানি শুরু করলে নতুন করে দাহ করা হয়।
প্রধানমন্ত্রিত্ব যাওয়ার পর কংগ্রেস রাওয়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে। তাঁকে আর নির্বাচনে প্রার্থী করা হয়নি। আসলে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন প্রধানমন্ত্রী রাও কার্যত হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। তিনি চাইলেই সেনা নামিয়ে মসজিদ রক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু বিন্দুমাত্র চেষ্টা ছিল না। মসজিদ ধ্বংস চলাকালে প্রধানমন্ত্রী দরজায় ছিল দিয়ে বসেছিলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, প্রথম গম্বুজ ভাঙা শুরু হলে রাও পুজোয় বসেন। ওঠেন শেষ গম্বুজ ভাঙা শেষ হলে।
অযোধ্যা মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সেই ঘটনাকে জঘন্যতম অপরাধ বলে উল্লেখ করেছে। সেই বেঞ্চের অন্যতম সদস্য ছিলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়। ওই ঘটনার তদন্তে গঠিত লিবেরহান কমিশন বাবরি ধ্বংস এবং পরবর্তী হিংসাত্মক ঘটনার জন্য রাও সরকারের ব্যর্থতাকেই সবচেয়ে দায়ী করে। বাবরি কাণ্ডের দিন কয়েক আগে রাও-আডবাণী-বাজপেয়ীদের একান্ত বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছিল তা রহস্যই থেকে গিয়েছে। সেই তিনজনই এখন ‘ভারতরত্ন’।
বাবরি ধ্বংসের ঘটনার পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব মাধব গোডবোলে ১৮ মাস আগে চাকরি থেকে অবসর নেন। বাবরি ধ্বংসের ঘটনার তদন্তকারী সিবিআই আধিকারিকদের তিনি জানিয়েছিলেন, আগাম অবসর ছিল তাঁর প্রতিবাদ। কারণ, মসজিদ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কোনও সিদ্ধান্তই শোনেননি। তিনি বলেছিলেন, উত্তর প্রদেশের কল্যাণ সিং সরকারকে বরখাস্ত করে, এলাকায় কার্ফু জারি করে অযোধ্যার অদূরে অবস্থিত ফৈজাবাদ সেনা ছাউনির জওয়ানদের দিয়ে মসজিদ ঘিরে দিতে।
শুধু কী তাই, নরসিংহ রাও সেই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, দুর্নীতির দায়ে আদালত যাঁকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল। যদিও বাকি জীবন জামিনে মুক্ত ছিলেন। শেয়ার দালাল হর্ষদ মেহতা রাওয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাংলোয় গিয়ে দেখা করেছিলেন, সে অভিযোগ মিথ্যা ছিল না। রাও একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যাঁর বিরুদ্ধে সরকার বাঁচাতে সাংসদ কেনাবেচার গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল।
সেই মানুষটিকে শতবর্ষ পেরনোর তিন বছর পর ভারতরত্ন ঘোষণার সিদ্ধান্তের পিছনে যে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানায় বিজেপির ভোটের অঙ্ক কাজ করছে, দুধের শিশুও তা বোঝে। যেমন প্রয়াত চরণ সিংকে মরণোত্তর সম্মান দিয়ে তাঁর নাতি জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডি-কে এনডিএ-তে শামিল করতে চাইছে বিজেপি। চারশো আসনের স্বপ্নপূরণে লোকসভার সে রাজ্যের ৮০টি আসনই এবার মোদী-শাহ দখল করতে চাইছেন। একইভাবে বিহারে বিশিষ্ট জননেতা কর্পূরি ঠাকুর-কে রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়ার তিনদিনের মাথায় নীতীশ কুমার ফের ডিগবাজি খেয়ে বিজেপির হাত ধরেছেন।
২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সেখানে বসেই শোনার সুযোগ হয়েছে আমার। ভাষণে বারে বারে রামরাষ্ট্রের কথা বলেছেন তিনি। বিজেপি দাবি করছে, ওই দিন রামরাজ্য অর্থাৎ সুশাসনের সূচনা হয়েছে। রাম মন্দিরকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাষ্ট্র চেতনার মন্দির। ‘ভারতরত্ন’ প্রদানে সেই সুশাসন মন্ত্র রক্ষা হচ্ছে কি?
রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার রাস্তা খুলে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের রায়। সেই রায়েই বিতর্কিত জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তীব্র নিন্দা রয়েছে। আমি আজও এই প্রশ্নের জবাব পাইনি, বাবরি মসজিদ অক্ষত থাকলে জমি বিবাদের মামলায় শীর্ষ আদালত কী রায় দিত? তারা কি রামজন্মভূমি থেকে মসজিদ সরিয়ে নিতে বলত। বারাণসী, মথুরার মামলায় আদালতের ভূমিকা সেই কারণে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অযোধ্যায় বাবরি ধ্বংসের অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের যখন রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে তখন অযোধ্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়কে বিবেচনায় রেখে বলতে হয়, সুপ্রিম কোর্ট হাত গুটিয়ে থাকতে পারে না।
অযোধ্যায় দাঁড়িয়ে মসজিদ ধ্বংস প্রত্যক্ষ করা আডবাণী, দরজায় খিল দিয়ে থাকা প্রধানমন্ত্রী রাও ‘ভারতরত্ন’ ঘোষিত হলে মন্দির আন্দোলনে নিহত এবং মসজিদ ধ্বংসকারী করসেবকেরাই বা বাদ থাকবেন কেন, এই প্রশ্ন হিন্দুত্ববাদীরাই তুলতে পারেন।
আজকের প্রধান বিচারপতির প্রতি প্রশ্ন, ভোটের টানে রাষ্ট্রীয় সম্মানের এই চৈত্র সেল দেখে সর্বোচ্চ আদালত হাত গুটিয়ে আছে কেন? আদালতের সুযোগ আছে, কর্তব্যও বটে, রাষ্ট্রীয় সম্মানের মর্যাদা রক্ষা করা। অযোধ্যা মামলার রায়ে যে ঘটনাকে শীর্ষ আদালত অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছিল, অপর এক মামলায় ‘জাতীয় অপরাধ’ বলে, সেই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তিদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়া আদালত অবমাননাও বটে।