জলের অক্ষর পর্ব ১৫
কুলদা রায়
আমাদের নরেন মুদিকে যে ইলিয়াস আলী নাই করে দিল, আর যে নরেন্দ্র মোদি গুজরাতের ফতিমার দুলহাকে খুন করতে বুলন্দ আওয়াজ দিল- এরা দুজনেই কিন্তু দুটো ধর্মের লোক। দুজনই তারা তাদের ধর্মে নিষ্ঠ। শুধু নিষ্ঠ হলে বিপদ ছিল না। কিন্তু বিপদ হতে শুর
শেষ আপডেট: 25 July 2021 11:22
কুলদা রায়
আমাদের নরেন মুদিকে যে ইলিয়াস আলী নাই করে দিল, আর যে নরেন্দ্র মোদি গুজরাতের ফতিমার দুলহাকে খুন করতে বুলন্দ আওয়াজ দিল- এরা দুজনেই কিন্তু দুটো ধর্মের লোক। দুজনই তারা তাদের ধর্মে নিষ্ঠ। শুধু নিষ্ঠ হলে বিপদ ছিল না। কিন্তু বিপদ হতে শুরু করল যখন তাদের ধর্মকেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে মনে করল। মনে করার মধ্যেও ঝামেলা কম। শুধু এই শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার মধ্যে দিয়ে অন্য ধর্মকে শত্রু ঘোষণা করল, অন্য ধর্মের অস্তিত্বকে নিজেদের ধর্মের জন্য বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করল। নিজের ধর্ম রক্ষার জন্য অন্য ধর্মের মানুষজনদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হত্যা করল। ধর্ষণ করল। সহায় সম্পত্তি কেড়ে নিল। দেশছাড়া করল। এটাই বিপদের জায়গা। এতকাল যাদের মধ্যে ধর্ম এই অন্ধত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছে— তারাই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম মানুষের লজিক কেড়ে নেয়। বিচারবোধ নষ্ট করে। হিংসা আর প্রতিহিংসার বীজ মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এই অন্ধ ধর্ম নিয়ে আমরা কী করব?
মনে করুন আমার এক পিসেমশাই। বরিশালের মঠবাড়িয়ার এক গ্রামে বাড়ি। মানবেন্দ্রর গান আর দিলীপকুমারের অভিনয়ের পাগল। তাঁর দিনদুনিয়াতে আর কিছু ছিল না। একাত্তর সালে তাঁকে মুসলমান হতে হয়েছিল। নাম হয়েছিল শাহজাহান। আর আমার পিসিমা মমতাজ। পিসতুতো ভাইগুলোর নাম দারাশুকো, সুজা, আলমগীর। বোনটির নাম জাহানারা। রেগুলার মসজিদে যেতে হত। তাঁদের পালের গরু জবাই করেও খেতে হয়েছে। মুখে রাখতে হয়েছে দাড়ি। কপালে দাগ পড়ে গিয়েছিল। একাত্তরের পরে আমাদের বাড়ি এসে সেই দাড়ি কেটেছিলেন। আর হাহাকার করেছিলেন। সেদিনই ঢোল-করতাল সহযোগে হিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন। তাতে তাঁর সমস্যা হয়নি।
কিন্তু সমস্যা হয়েছিল অন্যখানে। এর পরে তিনি অতিরিক্ত হিন্দু হয়ে গিয়েছিলেন। সবসময় মুসলমানদের পতন দেখতে চাইতেন। আমাদের মুসলমান বন্ধুদের দেখলে আড়ালে ডেকে নিয়ে আমাদেরকে চড় থাপ্পড়ও দিতেন। বলতেন, "বিধর্মী গো লগে মেশো, সাহস তো কম না!" তাঁর মেয়েটি একটি মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করলে তাকে ত্যাজ্য করেছিলেন। আছড়ে পিছড়ে কান্নাকাটি করেছিলেন— মেয়েটি তাঁদের অনন্ত নরকে ঠেলে দিল। অদ্ভুত!
আরেকজন পিসেমশাই চিরকাল শিক্ষা-দীক্ষা অন্তপ্রাণ। নিজের ছেলে-সন্তানদের কেউ কেউ দেশবিদেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার। এদিকে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। সেই পিসেমশাই আমাকে বলেছিলেন, "বোজলা বাবা, কৃষ্ণ ঠাকুর পুরুষোত্তম। বিএনপি-জামাতকে ধ্বংস করতে শ্রীকৃষ্ণ নতুন অবতার হয়ে আসবেন। চিন্তা করবা না। গীতায় এই কথা লেখসে। যিনি রাম--তিনিই কৃষ্ণ। তাঁদের একজন রামায়ণের পাতা থেকে ফাল দিয়ে পড়বেন। আরেকজন মহাভারতের পাতা থেকে সুদর্শন চক্র নিয়ে আসবেন। এসে বিধর্মীদের কচুকাটা করবেন।
নতুন অবতারের খবর নেওয়ার জন্য আমার গীতা পড়ার দরকার নেই। বাল ঠাকরে নামের এক লোক যখন হুংকার দিলেন— বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হবে। সেখানে আবার রামের নামের মন্দির গড়া হবে, তখনই বুঝলাম শ্রীঅবতার এসে গেছেন। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গোর নাম শিবসেনা। এরা মানুষ হলেও পাছায় ল্যাজ আছে। এদের নবীন নেতা নরেন্দ্র মোদি। তিনি রামরাজ্য চান। রামরাজ্যে অন্য ধর্মের লোকের কোনও জায়গা নেই। সোজা পুশব্যাক করে দাও। আফগানিস্তান-পাকিস্তানের তালিবানরাও এই কাজটি করছে। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীরাও এই কাজটি করে চলেছে। তাদের রাজ্যে মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের লোকেদের থাকতে দেবে না। যারা থাকতে চাইবে তাদের সোজা গুলি করে মারবে। এরা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
এই সাম্প্রদায়িকতা একটা ছোঁয়াচে অসুখ। মানুষকে পশু করে তোলে। সে সব সময়ই অন্য মানুষকে শিং উঁচিয়ে তাড়া করে।
কেউ ধর্ম পালন করে শান্তি লাভ করুক, আমার আপত্তি নেই। কেউ ধর্ম পালন না করেও শান্তি লাভ করুক তাতেও আমার আপত্তি নেই। তাদের ব্যক্তিজীবনে ধর্মে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করার অধিকার দুই-ই আছে। আধুনিক রাষ্ট্র তাদের সেই অধিকারকে নিশ্চিত করে। কিন্তু মওদুদির জামায়াতে ইসলামী বা মোদির বিজেপি সেই অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার দুঃসাহস দেখায়। এইখানেই জামায়াতে ইসলামীর উত্থান দেখলে আমি কেঁপে উঠি। মোদির বিজেপির উত্থানেও আতঙ্কিত হই। এরা কোনও রাষ্ট্র মানে না। নাগরিক স্বাধীনতা বোঝে না। জগতে মোদির কাছে হিন্দু আছে। জামায়াতের কাছে মুসলমান আছে। আর কেউ থাকতে পারে না।
আমরা ঠেকে শিখেছি, যে কোনও ধর্ম বা মত যখন শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে, সেটা তখন আর মত থাকে না- হিংসার অস্ত্র হয়ে ওঠে। এই হিংসার কাছে আমি তো আসলে কেউ নই। আমি বাংলাদেশে কুলদা রায়। আর ভারতে কলিমুদ্দিন শেখ।
আমি কাউকেই ভয় করি না। শুধু ভয় করি ধর্মত্ববাদীদের। তাদের চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি, তারা ঘৃণার আগুন পুষে রেখেছে। যেকোনও সময়েই তারা আগুন লাগিয়ে দিতে পারে সারা পৃথিবীতে।
ধর্মত্ববাদীরা শ্রেষ্ঠত্বের নামে একটি বিষাক্ত তির তাক করে রেখেছে সমগ্র মানবজাতির দিকে। তারাই শ্রেষ্ঠ, বাকি সবাই অধম। বাঁচার অধিকার নেই এই অধমদের।
এই ধর্মত্ববাদীরাই ঈশ্বরকে বানিয়ে রেখেছে ভয়ঙ্কর দানব হিসেবে। আর মানুষকে আতঙ্কিত করে বানাতে চাইছে সেই দানবের দাস।
প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর নন, ভয়ঙ্কর দানব হল এই ধর্মের ষাঁড়গুলো। তারা তাদের দানবগিরির বন্দুক ঈশ্বরের ঘাড়ে রেখে চালাচ্ছে।
ভারতে মোদি-অমিত শাহ সেই দানবীয় বন্দুক নিয়ে নেমে পড়েছে। তাঁদেরকে রুখে দাঁড়ান।
মনে রাখবেন, ৭১ সালে ধর্মের ষাঁড়গুলো খুন করেছিল বর্তমান বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ মানুষকে। এখনও মাঝেমধ্যেই তারা হত্যালীলা চালায়।
আসলে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ধর্মের কোনও দরকার নেই। নিজের মতো করেই তাঁকে পাওয়া সম্ভব।
(লেখক নিউইয়র্ক নিবাসী গল্পকার)
(স্কেচটি করেছেন তাজুল ইমাম)
পরের পর্ব মাসের চতুর্থ রবিবার...
https://thewall.in/opinion/opinion-blog-joler-okkhor-part-forteen-by-kuloda-roy/