ইংল্যান্ড-সার্বিয়া ম্যাচের পরে গেলশেনকার্খেন স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় সমর্থকরা। (ছবিঃ এপি)
শেষ আপডেট: 1st July 2024 14:25
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ইংল্যান্ডের সব দিক দিয়েই বিধি বাম। ফুটবলের জন্মভূমি বলে দাবি করে তারা। বিশ্বের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে বিখ্যাত ঘরোয়া লিগ হয় তাদের দেশে। সেই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখতে কলকাতার ফুটবলপ্রেমীরাও মুখিয়ে থাকেন। অথচ ইংল্যান্ডের জাতীয় দল নামলেই মোটামুটি শ্যামবাজার থেকে রাসবিহারী, আমজনতার বেশিরভাগই কতক্ষণে ইংল্যান্ড হারে দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠেন। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ভক্ত বাঙালি এখন ইউরোপীয় ফুটবলেই বেশি মজে। কোপা আমেরিকা ভারতে টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছে না। তার ওপর ভোররাতে উঠে কোপা দেখার চাইতে রাতে ইউরো দেখার অভ্যেসেই বুঁদ বেশিরভাগ। অথচ জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়ামের সমর্থক থাকলেও, ইংল্যান্ড মাঠে নামলেই যেন তামাম বাঙালি এককাট্টা। আর যে যাই করুক, ইংল্যান্ড যেন হারে!
উপনিবেশের ইতিহাসের ছায়া এইভাবেই আট দশক বাদেও ঘুরেফিরে বেড়ায় বাঙালি মননে। রবিবারের রাতে যেটা প্রায় সত্যি হয়ে যাচ্ছিল! নক আউটের প্রথম লড়াইতে শেষ ষোলোর ম্যাচে গেলশেনকার্খেনে স্লোভাকিয়ার সামনে পড়েছিল ইংল্যান্ড। আগেরদিন সুইজারল্যান্ড হারিয়ে দিয়েছে ইতালিকে। ইংল্যান্ড-বিরোধীরা অনেকেই আশায় আশায় ছিলেন, এইবার বুঝি ইংরেজ ইউরো ছাড়ো দাবিও ফলে যাবে! উত্তেজনা বাড়িয়ে ২৫ মিনিটের মাথায় স্লোভাকিয়ার ইভান শ্রানৎজ এগিয়ে দেন। লেক টাউনের মোড়ে তখন জনাকয়েক ফোন হাতে সরাসরি খেলা দেখছিলেন। স্লোভাকিয়ার গোল হতেই হঠাৎ করে এমন উল্লাস উঠল, যেন ডার্বিতে গোল করেছে মোহনবাগান!
পুরো নব্বই মিনিট ওই গোল আর শুধতে পারেনি ইংরেজরা। শেষ অবধি জুড বেলিংহ্যাম ও অধিনায়ক হ্যারি কেন অতিরিক্ত সময়ে না বাঁচালে কলকাতায় কী হত বলা মুশকিল। কিন্তু জার্মানিতে গ্যারেথ সাউথগেটের কপালে অশেষ দুঃখ লেখা থাকত! গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচে ইংল্যান্ড দল মাত্র দু'টি গোল করেছে। স্লোভেনিয়ার বিরুদ্ধে গোলশূন্য ড্র করায় গ্যারেথ সাউথগেটের দিকে বিয়ারের কাপ উড়ে এসেছে। সমস্বরে সমর্থকরা 'বু' করেছেন। সাউথগেট তাতে যারপরনাই ব্যথিত। এই অবস্থায় গেলশেনকার্খেনে বুন্দেশলিগার ক্লাব শালকের ঘরের মাঠে খেলা শুরুর আগে তাঁর নাম ঘোষণা হতেই ফের সমস্বরে 'বু' করতে দেখা গিয়েছে সমর্থকদের। ইংরেজরা বেজায় বিরক্ত তাঁর ওপর। এত বড় বড় নাম দলে, অথচ এরকম করুণ দশা কেন?
তার ওপর ইংরেজ ভক্তদের কপালে রাহুর দশা হয়ে দেখা দিয়েছে জার্মানির পরিবহন ব্যবস্থা!
গেলশেনকার্খেন ছোট শহর। কোলন বা ফ্রাঙ্কফুর্টের মত জমজমাট, ভিড়ভাট্টা সেখানে নেই। লন্ডন বা বার্মিংহ্যামে ইংরেজ ফুটবল সংস্কৃতি মানেই দেদার খানাপিনা (যেখানে আবার 'পিনা'-র পাল্লা অবধারিতভাবেই বেশি থাকে)-সহ পাব বা জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে বসে হট্টগোল। মহাজনের পথই পথ। এবারের ইউরোয় যেমন এই আমেজ আনতে কোনও কসুর করেননি জার্মান ফুটবল প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু সেই তালিকাতেও গেলশেনকার্খেন খানিক পিছিয়ে। হইহল্লা না-পসন্দ শহরের। ফলে বিয়ারের বিক্রি কমানো হয়েছিল। তার ওপর দর্শকদের যাতায়াতের জন্য যথেষ্ট গাড়িঘোড়ার ব্যবস্থা রাখেনি উয়েফা। গেলশেনকার্খেনে ট্রাম চলে। 'স্টেটবান' বলে মেট্রোরেলও চলে। ট্রেন তো আছেই। কিন্তু এত বড় প্রতিযোগিতা বা এই বিপুল পরিমাণ 'অভ্যাগত'দের জন্য নাকি তা বেশ অপ্রতুল! এর আগে গ্রুপের সার্বিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচ পড়েছিল এখানে। এদিকে সমর্থকদের চাপে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় নাভিশ্বাস উঠে যায়। বাসে, গাড়িতে জায়গা হয়নি অনেকের। স্টেডিয়ামে পৌঁছনোর তিন ঘন্টা আগে থেকে বিশেষ ট্রাম চালু হয়। তাতেও জায়গা হয়নি অনেকের। এদিকে ম্যাচ পড়েছে স্থানীয় সময় রাত ন'টায়। অথচ ম্যাচ শেষ হওয়ার তিন ঘন্টা পরেও একেবারে মধ্যরাতে নাকি স্থানীয় ট্রেন স্টেশনে আটকা পড়েছিলেন হাজার হাজার ইংরেজ সমর্থক। ট্রামে চিঁড়েচ্যাপ্টা অবস্থা হয়েছিল অনেকের। বাধ্য হয়ে রাতবিরেতে কয়েক মাইল করে হাঁটতে হয়েছে অনেককে।
যুবভারতীতে বড় ম্যাচ থাকলে অবশ্য কলকাতাবাসীর কাছে এই ছবি অতি চেনা। গাড়ি নিয়ে পার্কিং-এ জায়গা পেলে তো ভাল। না পেলে বাসের ভরসায় গেলে হয়রানি নিত্যদিনের ঘটনা। হয় বাস পেতে এগিয়ে যেতে হবে চিংড়িহাটার দিকে। নয়ত বেলেঘাটা বাইপাসের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। যদি সেখানে দাঁড়াতে দেয় তো ভাল। না হলে হাঁটা দিতে হবে ওদিকের কাদাপাড়ার দিকে। ভিড়ে ঠাসা, পাদানিতে জায়গা পাওয়া সমর্থকদের নিয়েই রওনা দেয় নিত্যদিনের বাস। ভারতে অনুর্দ্ধ সতেরো বিশ্বকাপ চলার সময় বা পরে আইএসএলের ম্যাচ থাকলে বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করে রাজ্য পরিবহন দফতর। কিন্তু সেও প্রয়োজনের তুলনায় আর ক'টা?
বাঙালিরা যুবভারতীতে এসব মুখ বুজে মেনে নিলেও গেলশেনকার্খেনে এই হয়রানি নিয়ে বেজায় চটেছিল ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। ক্ষেপে গিয়েছিল সমর্থকদের সংগঠনও (আজ্ঞে হ্যাঁ, এরকম সংগঠনও আছে, 'ফুটবল সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন')। কড়া চিঠি লেখা হয়েছিল উয়েফাকে। সাফ কথা, উয়েফাকে এবং জার্মান প্রশাসনকে আগেভাগেই জানানো হয়েছিল, ইংল্যান্ডের সমর্থকরা ম্যাচ দেখতে শহরে ভিড় জমাবেন। তাহলে সেরকম ব্যবস্থা রাখা হয়নি কেন? তাই আগে থেকেই এবার বাড়তি সতর্কতা নিয়েছিল প্রশাসন। শাটল বাস নামানো হয়। প্রতি দুই মিনিট অন্তর ট্রাম চালানো হয়। সব মিলিয়ে ভালয় ভালয় উৎরেছে ম্যাচ। ইনজুরি টাইমে গোল করে কেন ও বেলিংহ্যামও সমর্থকদের হাসি চওড়া করেছেন।