শেষ আপডেট: 10th June 2024 22:42
দ্য ওয়াল ব্যুরো: 'বন্ধু হারালে দুনিয়াটা খাঁ খাঁ করে, ভেঙে যায় গ্রাম, নদীও শুকনো ধূ ধূ!' সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সাঁকোটা দুলছে' কবিতার এ লাইন খানা বহু মানুষের বুকেই নানা সময়ে হাহাকার করে বেজেছে। ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার মতো বা তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদের মতো কষ্ট বোধহয় দু'টো নেই। প্রেম ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণাও কম নয়, ঠিকই, তবে বন্ধুত্ব যেন আরও গভীর কিছু। অথচ প্রেম ভাঙা নিয়ে যত হা হুতাশ শোনা যায়, বন্ধুত্ব নিয়ে ততটাও নয়। অথচ ভাঙা প্রেমের মতোই, ভাঙা বন্ধুত্ব জোড়া লাগানোর উপায় নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। প্রয়োজন চর্চারও।
আসলে, বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক, তা যতই স্পেশ্যাল হোক না কেন, বন্ধু বিনে যতই প্রাণ না বাঁচুক কেন, দিন শেষে তা অটুট কোনও বন্ধন নয়। আর পাঁচটা সম্পর্কের মতোই প্রিয়তম বন্ধুদ্বয়ের মধ্যেও ফাটল ধরতে পারে, বন্ধুত্ব ভেঙেও যেতে পারে। এর কারণ হতে পারে অনেক রকমই। যেমন, এক বন্ধু ডেটিং করতে শুরু করল আর এক বন্ধুর প্রাক্তনের সঙ্গে। অথবা, এক বন্ধু বিদেশে গিয়েই বিশেষ সম্পর্কে থিতু হয়ে গেল, এদেশে সদ্য ছেড়ে যাওয়া বন্ধুকে কিছু না জানিয়েই। আবার হয়তো কেউ কাউকে অনিচ্ছাকৃতভাবেই আঘাত করে ফেলল, নিজের আদর্শে স্থির থাকতে গিয়ে। শেষ পর্যন্ত ভাঙা বন্ধুত্বের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, অভিমান, যন্ত্রণা, ভুল বোঝাবুঝির মধ্যেই পেরোতে থাকে সময়। বাড়তে থাকে কোনও এক পক্ষের বা দু'পক্ষেরই একাকীত্ব। অপরাধবোধ এবং তিক্ততার অনুভূতিও আসতে পারে, প্রেম ভাঙার মতোই। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অনেক সময়ে মনের মধ্যে পুরনো ক্ষতর মতো থেকে যায় রঙিন স্মৃতির ভিড়।
তবে বন্ধুত্ব ভাঙার কষ্ট সহ্য করা যতটা কঠিন, বন্ধুত্ব জোড়া লাগানো কিন্তু ততটা কঠিন নয়। এক্ষেত্রে পরস্পরকে আর একটি সুযোগ দেওয়া নিয়ে ভাবাই যেতে পারে। কারণ এই বিষয়টি প্রেমের মতো অতটা জটিল নয়, আত্মসম্মানে লাগারও কথা নয়। বহু খারাপ লাগা পার করে ফেলা যায়, প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পাওয়ার যে স্বস্তি ও শান্তি, সে কথা ভেবে। বলতে গেলে, ভাঙা বন্ধুত্ব মেরামতির মতো অনাবিল সুখ কমই আছে।
তবে যে কোনও সম্পর্ক নতুন করে জোড়া লাগানোর মতোই, বন্ধুত্বের ক্ষেত্রেও কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে বলে মনে করছেন মনোবিদরা। সবার প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, আপনি কি বন্ধুকে মিস করেন? অথবা বন্ধুর সঙ্গে কাটানো ভাল সময়গুলো কি খারাপ সময়গুলোর চেয়ে অনেকটা বেশি ছেয়ে আছে আপনার মনে? বন্ধুর সঙ্গ কি আপনাকে আরও ভাল মানুষ করে তোলে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি ইতিবাচক হয় এবং বিচ্ছেদের যে কারণ তা যদি খুব বেশি গুরুতর কিছু না হয়, তবে বন্ধুত্ব জোড়া লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারে।
মনোবিদরা আরও বলছেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে বারবার ভাবুন, এই বন্ধুত্বের পজিটিভ দিকগুলি কী কী এবং সেগুলির দ্বারা আপনি কতটা প্রভাবিত? আরও ভাবুন, বন্ধুর যদি কোনও ত্রুটি থেকে থাকে, তা ক্ষমার যোগ্য কিনা। একই সঙ্গে ভাবুন, উল্টোদিকে থাকা আপনার বন্ধুটিও সম্পর্ক জোড়া দিতে আপনার মতোই ইচ্ছুক কিনা। সবশেষে ভাবুন, এই বন্ধুত্ব ফিরে এলে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যে কোনও সমস্যা হবে না তো?
এই সবক'টি বিষয়ে নিশ্চিত হলে, বন্ধুত্ব জোড়া লাগানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপটি করতেই পারেন আপনি নিজে। তবে তা এত সহজ নয়। চাইলেই এগিয়ে গিয়ে ফের ভাঙা বন্ধুত্ব মেরামতি করে ফেলা যায় না। নিজের মনের ভিতরে অনেক স্তর পেরিয়ে তবেই সফল হয় এই পদক্ষেপ।
প্রথমেই নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার থাকতে হবে, বন্ধুর সঙ্গে আপনার কী নিয়ে সংঘাত হয়েছিল, তাতে আপনার ভূমিকা কী ছিল। যদি মনে হয় আপনার নিজের কাজের জন্য জবাবদিহি দেওয়া প্রয়োজন, তাহলে পিছপা হবেন না। অপর পক্ষের উপর সমস্ত দোষ দিলে গোটা বিষয়টিই ফের তিক্ত হয়ে যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন হল, ভাবনাচিন্তার পালা শেষ হলে, সিদ্ধান্ত স্থির হলে, নিজের আচরণ ঠিক করে ফেলার পরে, কী করতে হবে?
প্রথম কল বা মেসেজ করতেই পারেন আপনি নিজে। হতে পারে, উল্টো দিক থেকে ততটা উষ্ণ রিপ্লাই হয়তো পেলেন না প্রথমে। সেক্ষেত্রে মুখ ফিরিয়ে না নিয়ে অপেক্ষা করুন। সময় দিন। সপ্তাহখানেক পরে আরেকবার কথা বলুন। সংশোধনের কথা জানান, সত্যিকারের ক্ষমা চেয়ে নিন। আপনি নিজে যা যা করেছিলেন বিচ্ছেদের সময়ে, সেগুলির পিছনে যুক্তি সাজানোর বদলে, ভুল স্বীকার করাই এক্ষেত্রে শ্রেয়। দোষারোপ কখনওই কোনও সমাধান নয়। বরং তার চেয়ে বেশি জরুরি, নিজের ত্রুটি মেনে নিয়ে, অপরপক্ষ কেন ভুল করেছিল, সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝার চেষ্টা করা। এটা বলা বা লেখা যত সহজ, কাজে করা ততটা নয়। কিন্তু এই উদারতা খুবই জরুরি, হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য। বিশ্বাস ফিরে না এলে সম্পর্ক সহজ হয় না।
এর পরের ধাপগুলি খুব কঠিন নয়। বন্ধুর প্রতি যত্ন দেখান, বন্ধুকে অভিনন্দন জানান তাঁর ছোট ছোট কৃতিত্বের জন্য। একসঙ্গে জিম জয়েন করতে পারেন, যেতে পারেন পার্লারে। শপিং বা রেস্তরাঁর পথ তো খোলা আছেই। মেলামেশা যত বাড়বে, যত সময় একসঙ্গে কাটবে, যত মনের কথা শেয়ার করার সুযোগ হবে, বন্ধুত্বের পুরনো ভাইবও তত দ্রুত ফিরে আসবে।
তবে ভাঙা বন্ধুত্ব জোড়া লাগার জন্য সময় দিতে হবে। রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে না। দু'পক্ষেরই প্রথমে সমস্যা হতে পারে, নতুন করে সবটা মানিয়ে নেওয়ায়। একটু বাধো বাধোও ঠেকতে পারে, দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরে আবারও বন্ধুত্বে ফিরতে চাইলে। তবে দু'জনেই সৎভাবে ফিরতে চাইলে, একসময়ে ফাটল মেরামত হবেই। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যের সঙ্গে সহানুভূতির যোগ্য সঙ্গত খুব জরুরি। জরুরি ধারাবাহিক ও পারস্পরিক চেষ্টা। ভাঙা বন্ধুত্ব জোড়া লাগানোর পথ কখনওই একতরফা হতে পারে না। যাওয়া-আসার দু'টি দিকই খোলা থাকতে হবে সেখানে।
সবশেষে মনে রাখতে হবে, আপনার সর্বোত্তম চেষ্টার পরেও বন্ধুত্ব আগের মতো নাও ফিরতে পারে। এমনটা হলে, অতীত নিয়ে চিন্তা করবেন না। ভেঙে পড়বেন না। নিজেকে ব্যর্থ ভাববেন না। বরং বন্ধু কেন ফিরতে চাইলেন না সম্পর্কে, সেই কারণটিতে সম্মান করুন। একই সঙ্গে গুরুত্ব দিন নিজেকেও। পার করে আসুন পুরনো সময়টাকে।