শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছবি- আবার আসিব ফিরে
প্রথম প্রদর্শন- কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ২৩
কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ, পরিচালনা- দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত 
অভিনয়ে- ঋতব্রত, ফাল্গুনি, মীর, শুভশ্রী, শঙ্কর 
সংগীত- রাতুল শংকর

'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে– এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়– হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়।'

পুনর্জন্মে আবার বাংলায় ফেরার অঙ্গীকার করেছিলেন রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাস। সেই কবিতার নির্যাস নিয়েই পরিচালক দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত বানিয়েছেন তাঁর ফিচার ফিল্ম 'আবার আসিব ফিরে'। তবে পুনর্জন্মে নয়, এ জন্মেই দেশের মাটিতে ফেরার গল্প বলেছেন দেবপ্রতিম। সহজ সরল উপস্থাপনে বড় বার্তা দিয়েছেন পরিচালক। 

দেবপ্রতিম, মৃণাল সেনের স্কুলিং-এ শিক্ষিত অভিনেতা। তাঁর কেরিয়ারের শুরু প্রবাদপ্রতিম পরিচালকের হাত ধরে। মৃণাল সেনের 'খারিজ' ছবিতে পালানের বন্ধু ছোট্ট ছেলে হরিকে মনে পড়ে? অপাপবিদ্ধ মুখ আর অপলক চোখ! সেই হরির চরিত্রটি করেছিলেন দেবপ্রতিম। বড় হওয়ার পর টালিগঞ্জ পাড়াতে কমেডি থেকে সিরিয়াস অ্যাক্টিং, মঞ্চ থেকে পর্দা, সবেতেই সমান তালে কাজ করে চলেছেন দেবপ্রতিম। এবার তাঁকে পরিচালক রূপে দেখা গেল। তবে দেবপ্রতিম ছবি বানাচ্ছেন অনেকদিনই। সেগুলো কলকাতায় মুক্তির আলো এখনও দেখেনি। দেবপ্রতিম জানালেন "এর আগে 'আর একটা রূপকথা' নামে ছবি বানিয়েছিলাম। যেটা বিদেশে কিছু হলে চলেছে, তারপর ওটিটিতে মুক্তি পেয়েছিল। 
আর প্রথম ছবি- 'ত্রাস বুনন' ২০১৭ থেকে প্রযোজকের দয়ায় অন্ধকারে।"

তাই আলো পাওয়া প্রথম কাজ 'আবার আসিব ফিরে'। 

২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলা প্যানোরমা বিভাগের শেষদিনে দেখানো হল দেবপ্রতিম দাশগুপ্তর 'আবার আসিব ফিরে'। ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলা ছবির তরুণ তুর্কি ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। পরিচালক দেবপ্রতিমের কথায় "আমার বাংলা সমৃদ্ধ তার ভাণ্ডার নিয়ে, লোকগান, প্রকৃতি, লৌকিক দেবতা, নাটক, সিনেমা সব কিছু নিয়ে সে এক রত্ন ভাণ্ডার।"

 একজন প্রথমবার বাংলায় এসে কী দেখে, কী পায় সেটা নিয়েই ছবি বানিয়েছেন দেবপ্রতিম।

"এই ছবিতে ঋতব্রতর জার্নি একটা মেল ট্রেনের মতো, সব স্টেশনে দাঁড়ায়নি, কিছু জংশনে ক্ষণিক থেমে আবার এগিয়ে যায়।
অনেকগুলো ছোটগল্পকে এড়িয়ে শুধু জার্নিতেই কী পেলাম সেটাই এই ছবির গল্প। একটা মিউজিক্যাল জার্নি," জানিয়েছেন পরিচালক।

সিনেমায় ঋতব্রতর চরিত্রর নাম প্যাডি। যে দেশে ফিরেছে এই প্রথম। ছেলেটির বাবা-মা বিদেশে থাকেন। দাদুর বনেদি বাড়ি দেখতে নাতি এ দেশে ফিরেছে। নাতির ফেরার আনন্দের মধ্যেও লুকিয়ে আছে বিষাদের সুর। কারণ জন্মের সময় নাতির মুখ দাদু দেখেননি। তার পেছনেও রয়েছে একটি কারণ। ছেলেটির মা অসবর্ণ বিবাহ করায় তাঁর বাবা মেয়ের বিয়ে মেনে নেননি। কিন্তু নাতি দেশে ফিরতে বয়সের ভারে সময়ের চাপে একলা হয়ে যাওয়া দাদু জীবনে নতুন ছন্দ ফিরে পেয়েছেন। যদিও দাদুর জীবনেও লুকিয়ে রয়েছে অন্য এক গল্প, জানতে গেলে দেখতে হবে ছবিটি।

প্যাডির প্রেমিকাও এখানকার মেয়ে। বাংলার বিভিন্ন লোক সংস্কৃতি খুঁজে পেতে প্যাডিকে বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখতে বলেন দাদু। আর ঘুরতে ঘুরতেই নানা অভিজ্ঞতায় ভরে উঠতে থাকে প্যাডির ঝুলি। গল্প এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক পরত উন্মোচিত হতে শুরু করে ছবিতে। 

দেবপ্রতিমের 'আবার আসিব ফিরে' আদতে একটি মিউজিক্যাল ছবি। বাংলার নানা প্রান্তের লোকগান, লোকনৃত্য ও লৌকিক দেবদেবীর ব্রতকথাকে এ যুগের ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে, যা এই ছবির সবথেকে বড় প্রাপ্তি। অবাঙালি সংস্কৃতির ভিড়ে বাংলার হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি যেন জেগে উঠেছে এই ছবিতে। সুন্দরবন, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার আদি লোকাচার উঠে এসেছে ছবিতে। টুসু পুজোর গান আর টুসু দেবীর ছোট্ট মিষ্টি মূর্তি মনে থেকে যাবে। পুরুলিয়ার পাহাড়ের মাঝে ছৌ নাচের দৃশ্যায়নও চোখ জুড়িয়ে দেবে। সেই দৃশ্যে পর্দায় যেন এক স্বর্গীয় মুহূর্ত তৈরি হয়। পরমেশ্বর হালদারের চিত্রগ্রহণ ভীষণ ভাল।

ছবিতে মূল চরিত্রে ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় সাবলীল ও সহজাত। তবে কিছু জায়গায় 'এনআরই' সাজা যেন আরোপিত লাগে, বিশেষত উচ্চারণে। তবে সাবলীল প্রাণোচ্ছ্বল অভিনয়ে ঋতব্রতই এ ছবির প্রাণভোমরা। যে ছেলেটি বাংলার উপর নতুন করে প্রাণের টান খুঁজে পায়। ছবিতে ফাল্গুনি চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্র আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে মূল অভিনেতারা বেশিরভাগই নতুন। তাঁদের মধ্যে সবথেকে প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন সৌরভ বিট্টু। নতুনরা থাকলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছেন বেশ কিছু নামী অভিনেতা। তুলিকা বসু, মীর, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, ডাক্তারের চরিত্রে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, লোকনাথ দে, পার্থসারথি, একটি বলিষ্ঠ চরিত্রে শঙ্কর দেবনাথ এবং গ্ল্যামার কুইন শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় বিশেষ অতিথি শিল্পী। শুভশ্রীর চরিত্রটি প্যাডির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ক্যামিও রোলে কাঞ্চনা মৈত্র বেশ নজরকাড়া।

বাংলার হারিয়ে যাওয়া লোকগান নিয়ে 'আবার আসিব ফিরে' ছবিটি আদতে এক সুরেলা জার্নির গল্প। মাটির গান আর মনোরম দৃশ্য এক হয়ে গেছে ছবিতে। ইন্দ্রনীল সেন, জোজো মুখোপাধ্যায়, দুর্নিবার, অভীক মল্লিক, রূপম ইসলাম সহ আরও অনেকে গান গেয়েছেন এই ছবিতে। সংগীত পরিচালনায় রয়েছেন রাতুল শংকর। 

ছবিটি কতটা গ্রহণযোগ্য হবে সেটা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পর দর্শকরাই বিচার করবেন। তবে এই ছবিতে নিজের মনের কথা ছবিতে এঁকেছেন দেবপ্রতিম। বক্সঅফিসে সাফল্যের খতিয়ানের বদলে নিজের গল্প বলাটুকুর উপরেই জোর দিয়েছেন তিনি। ছবিটি করতে তাঁকে যে আউটডোরে নিদারুণ খাটতে হয়েছে, তা বোঝা যায়। এই ছবি একটি সৎ প্রচেষ্টা। নবীন প্রজন্মকে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায় ফেরানোর জন্যই যেন পর্দায় নিপুণ হাতে ছবি এঁকেছেন দেবপ্রতিম।