শেষ আপডেট: 20th February 2024 20:02
আজ ভোরে নিজ বাসভবনে প্রয়াত হয়েছেন স্বর্ণযুগের গায়িকা, সুরকার, বাংলা ছবির প্রযোজক অসীমা মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। অসীমা ছিলেন অভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। গানেগল্পে অসীমা মুখোপাধ্যায়ের অশ্রুত আখ্যান লিখলেন শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৯৬৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল তারকাখচিত বাংলা ছবি ‘চৌরঙ্গী’। সাহিত্যিক শংকরের উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবি পরিচালনা করেন পিনাকী মুখোপাধ্যায়। উত্তমকুমার, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, সুপ্রিয়া দেবী, উৎপল দত্ত, বিশ্বজিৎ, অঞ্জনা ভৌমিক, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়… একই ছবিতে এতজন স্টার। গ্ল্যামারেই শিরোনামে ছিল 'চৌরঙ্গী'। ছবি মুক্তির আগেই লোকের মুখে মুখে ঘুরেছিল মান্না দে-র কণ্ঠে ও উত্তমকুমারের লিপে সেই নিশিযাপনের গান ‘বড় একা লাগে এই আঁধারে’। কেউ প্রথমে বিশ্বাস করতেই চায়নি এই গানের সুরকার একজন মহিলা-তিনি অসীমা মুখোপাধ্যায়। তখন ছিলেন অসীমা ভট্টাচার্য। একজন মহিলা যে সুরকার গীতিকার হয়ে সফল হতে পারেন তা বিশ্বাস করত না তখনকার সমাজ। তবে অসীমার আগে বাঁশরী লাহিড়ি, অরুন্ধতী দেবী বা অসীমার সমসাময়িক নীতা সেন মহিলা সুরকার হিসেবে সংগীত পরিচালনা করেছেন। কিন্তু চৌরঙ্গীর ‘বড় একা লাগে' সব হিটের রেকর্ড ভেঙে দিল, যা দিয়ে শিরোনামে উঠে এলেন সুরকার অসীমা মুখোপাধ্যায়।
‘বড় একা লাগে' গানে সুর করার কথাই ছিল না অসীমার। কারণ এত বড় মাল্টিস্টারার ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব বিশাল ব্যাপার। তাই ভাবা হয়েছিল চৌরঙ্গীর সুর করবেন শচীন দেব বর্মণ। ঘটনাচক্রে অসীমাই ছিলেন চৌরঙ্গীর প্রযোজক। বম্বেতে গিয়ে শচীন কর্তাকে দিয়ে সুর করানো বিশাল টাকার ব্যাপার। সেই বিপুল অঙ্কের টাকা ছবির খরচা বাঁচিয়ে জোগাড় করা গেল না। শেষ অবধি সুরকার না পেয়ে চৌরঙ্গীর গান তৈরির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন অসীমা। গীতিকার ছিলেন মিল্টু ঘোষ। শুধুমাত্র 'বড় একা লাগে' গান নয়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে বিশ্বজিতের লিপে 'কাছে রবে কাছে রবে' গানটিও মাদকতা তৈরি করে। আবার অঞ্জনা ভৌমিকের লিপে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে 'এই কথাটি মনে রেখো' রবীন্দ্রনাথের গানে অভূতপূর্ব সংগীতায়োজন কী ভোলা যায়? হোটেলের গ্ল্যামার থেকে আলো আঁধারের কাহিনী নিয়ে গল্প 'চৌরঙ্গীর'। তাই ক্যাবারে নাচের দৃশ্যেও দুর্দান্ত মিউজিক করেন অসীমা মুখোপাধ্যায়। মহানায়কের সঙ্গেও অসীমার গড়ে ওঠে দিদি আর ভাইয়ের বন্ধুত্ব। উত্তমকুমার অসীমার থেকে বড় হলেও অসীমাকে উত্তম দিদি বলতেন। অসীমার থেকে ভাইফোঁটাও নিতেন উত্তম। এমনকী প্রণামও করতেন অসীমাকে। 'চৌরঙ্গী' ছবি করে সফল প্রযোজক হিসেবেও অসীমা শিরোনামে চলে আসেন।
অসীমা মুখোপাধ্যায়কে 'চৌরঙ্গী'র পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। দোলনা, মেমসাহেব, বাঘবন্দী খেলা,শুভ রজনী র মতো ছবি বানিয়েছেন। মেমসাহেব ছবিতে অসীমা নিজে গেয়েছিলেন অপর্ণা সেনের লিপে সেই অতুলপ্রসাদী 'বধূঁ এমন বাদলে তুমি কোথা'। আজও বর্ষণমুখর রাতে এ গানের কথা আমাদের মনে পড়ে। গায়িকা অসীমা ভট্টাচার্য মুখোপাধ্যায় বলতেই প্রথমেই মনে পড়ে এই গান। মেমসাহেব এর মান্না দে-অসীমা ডুয়েট গেয়েছিলেন 'আজ বুঝি পাখিরা', যা প্রেমের গানে আজও অনেকের পছন্দের লিস্টে। উত্তম-অপর্ণার রোম্যান্টিক রসায়ন এই গানের দৃশ্যে অসাধারণ।
অসীমা মুখোপাধ্যায় ছিলেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের ছাত্রী। ১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'প্রতিদান' ছবিতে শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন অসীমা 'আজকে আমার সুরে সুরে'। অসীমা যখন 'দোলনা' ছবি প্রযোজনা করলেন তখন মাস্টারমশাই শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরেই লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ালেন সেই বিখ্যাত গান 'আমার কথা শিশির ধোয়া হাস্নুহানার কলি।'
সুরকার হিসেবে অসীমা মুখোপাধ্যায় ছবিগুলি হল চৌরঙ্গী, মেমসাহেব, শুভ রজনী, আজকের নায়ক, তনয়া, নিশান্তে, দাবার চাল, বিনয় বাদল দীনেশ, তাঁদের স্বপ্ন, অবশেষে।প্রযোজক রূপে অসীমার শেষ ছবি ছিল 'এক বিন্দু সুখ', যা মুক্তি পায়নি। আবার পরিবেশক রূপেও অসীমা সফল,যা খুব একটা আলোচিত হয়নি। তীরভূমি, গড় নাসিমপুর, জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার, দোলগোবিন্দের কড়চা প্রভৃতি ছবির ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বে ছিলেন অসীমা।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে বাংলায় এম এ করেছিলেন অসীমা। তাঁর কেরিয়ারের আরো একটি দিক তিনি ছিলেন আকাশবাণীর অন্যতম প্রযোজক। মিউজিক প্রোডিউসার। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন সরকার চেয়েছিলেন আকাশবাণীর চিরাচরিত মহালয়ার অনুষ্ঠান বদলে দিতে। সেই নির্দেশেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার অনুষ্ঠান বদলাতে বাধ্য হন অসীমা। অসীমা শুধুমাত্র দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু এটা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ হয়। আকাশবাণীর অফিসে ফোনে রীতিমতো গালাগালি দেয় শ্রোতারা। সেই দুর্যোগের দিন সামলেছিলেন অসীমা। একান্ত গল্পে অসীমা দেবী আমায় জানিয়েছিলেন "মহালয়ার অনুষ্ঠান বদলাতে আমি চাইনি। যা করেছিলাম তৎকালীন সরকারের নির্দেশে। আমরা করতে বাধ্য ছিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আমি নির্বাচন করি সংগীত পরিচালক রূপে। পঙ্কজ মল্লিকের পর হেমন্তদার নামটাই আসে। হেমন্তদাকে বলেছিলাম এই মহালয়ায় যদি উত্তমকুমারকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ করানো যায় কেমন হয়? উত্তমবাবু তখন ব্যস্ত তবু আমরা বলায় রাজি হন স্বল্পসময়ের ভাষ্যপাঠে। কিন্তু মিডিয়া প্রচার করল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র জায়গায় উত্তমকুমার! এটা নেগেটিভ প্রভাব ফেলে অনুষ্ঠানে। উত্তমবাবু ছাড়াও তো ভাষ্যপাঠে গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, ছন্দা সেন, পার্থ ঘোষরা ছিলেন। কিন্তু একক উত্তম প্রচারে চোনা পড়ে গেল গঙ্গাজলে। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সবাই গেয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানে।"
ব্যক্তিগত জীবনে অসীমা ভট্টাচার্য দুটি বিবাহ করেন। তাঁর প্রথম স্বামীর পদবী ছিল ভট্টাচার্য। প্রথম পক্ষের একটি মেয়েও হয়। নাম পম্পি। মেয়ের নামে প্রযোজনা সংস্থা খোলেন অসীমা। উত্তমকুমারের মহলেই অসীমার সঙ্গে আলাপ হয় অভিনেতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ের। পার্থ তখন টালিগঞ্জ পাড়ার চকোলেট হিরো। আসল নাম পার্থসারথি মুখোপাধ্যায়। তপন সিনহার 'অতিথি' ছবি করেই পার্থ শিরোনামে চলে আসেন, পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। তরুণ মজুমদারের 'বালিকা বধূর' নায়ক হন পার্থ।
উত্তমকুমারের ভাই বা ছেলের রোল হলেই পার্থ সবার প্রথম পছন্দের। 'ধন্যি মেয়ে' বা 'বাঘবন্দী খেলা'য় পার্থকে কেউ ভুলবে না। আবার সুচিত্রা সেনের 'ফরিয়াদ' ছবিতেও সুচিত্রার ছেলের রোলে চ্যালেঞ্জিং অভিনয় করেন পার্থ। বাঘবন্দী খেলা ছবির প্রযোজক ছিলেন অসীমা ভট্টাচার্য। অসীমা তখন টলিউডের একজন পাবলিক ফিগার, খ্যাতনামা প্রযোজক। পার্থ নবাগত উঠতি অভিনেতা। দুজনের বয়সের তফাত বেশ অনেকটা। তবু অসীমার আঁচলে বাঁধা পড়লেন পার্থ, ন বছরের বড় অসীমা ভট্টাচার্যকে এক মেয়ে সমেত বিয়ে করেন পার্থ মুখোপাধ্যায়। পার্থর এই অসম বিয়ে পার্থর পরিবার মেনে নিতে পারেনি। এমনকী এতটা বয়সে বড় মহিলাকে বিয়ে করার জন্য পার্থর প্রতি রুষ্ট হন উত্তমকুমারও। পার্থর সঙ্গে কথা বন্ধ রেখেছিলেন মহানায়ক। বয়সের তফাত শুধু নয় পার্থর মতো প্রতিভাবান অভিনেতার এত তাড়াতাড়ি এমন মেয়ে সমেত মা কে বিয়ে করার মানে কী! এটাই মানতে পারেননি অনেকে। অসীমা ভট্টাচার্য থেকে হন অসীমা মুখোপাধ্যায়। তখনকার মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে এই বিয়ের খবর রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে পার্থ-অসীমা ভালবেসে বিয়ে করেন।
বিয়ের পর পার্থকে নায়ক করে অসীমা কিছু ছবি করলেও সব কটি ফ্লপ করে। অনেকেই মনে করত অসীমাকে বিয়ে করাই ছিল পার্থর শেষের শুরু। কিন্তু কেউ কি কারও ক্ষতির কারণ হতে পারে? বরং প্রযোজক সংগীত পরিচালক অসীমা পার্থকে হিরো হিসেবে লঞ্চ করতেই চাইছিলেন বারবার। পার্থ নিজেই পেরে ওঠেননি সমসাময়িক রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে বা তাপস পালদের সঙ্গে। কম উচ্চতা পার্থ মুখোপাধ্যায়ের হিরো হওয়ার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে ভাল ছবি হাতছাড়া হওয়া এসব তো থাকেই। যদিও অসীমা পার্থর সুখী দাম্পত্য ছিল। কিন্তু স্বর্ণযুগের পর পার্থ-অসীমা জুটির নতুন কাজ আমরা কম পেতে লাগলাম। সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত 'জননী সিরিয়ালে মেজো খোকার চরিত্রে প্রথম ছোটপর্দায় অভিনয় করেন পার্থ।
২০১৭ সালে প্রয়াত হন পার্থ মুখোপাধ্যায়। বয়স তখন সত্তর। পরে একমাত্র মেয়ে ও নাতনির দায়িত্বে থাকতেন অসীমা দেবী। স্বর্ণযুগের বহু ঘটনার সাক্ষী তিনি। বাংলা গান ও ছবি যতদিন থাকবে তিনি থাকবেন।
কিন্তু অসীমা মুখোপাধ্যায়কে ফোন করলেই বহুবার পরিতাপ করে বলতে শুনেছি "আমি কে? আমার খোঁজ কেউ রাখে? আমার বাংলা গান আর বাংলা ছবিতে কন্ট্রিবিউশন কেউ মনে রেখেছে?"
ঠিক একইভাবে হতাশায় ভুগতেন পার্থ মুখোপাধ্যায়। স্বর্ণযুগে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী যে তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন পরে ক্রমশ খবরের বাইরে চলে যেতে থাকেন। কিন্তু চৌরঙ্গী, মেমসাহেব, অতিথি, গল্প হলেও সত্যি, বাঘবন্দী খেলা প্রভৃতি ছবি দিয়ে বেঁচে থাকবেন পার্থ- অসীমা। আজ তাঁদের ভালবাসার পথ শেষ হল ইহলোকে। যার শুরু হয়তো আবার পরলোকে হল। সমালোচনার শিকার হলেও তাঁদের ভালবাসা চিরশাশ্বত।