কোপা ফাইনালের আগে রণক্ষেত্র মায়ামিতে।
শেষ আপডেট: 17th July 2024 15:05
দ্য ওয়াল ব্যুরো: মায়ামির দৃশ্য দেখে মনে হতেই পারে, বোধ হয় ফিফা কর্তারা এবার খাতা-পেন খুলে নতুন করে হিসেবনিকেশ করতে বসলেন।
মায়ামিতে যা হল, কলকাতার যুবভারতীতেও বোধ হয় এমন দৃশ্য দেখা যায় না! হাইভোল্টেজ কোপা আমেরিকা ফাইনাল! মুখোমুখি বিশ্বজয়ী লিওনেল মেসির আর্জেন্তিনা ও হামেস রদ্রিগেজের কলম্বিয়া। খেলা শুরুর কথা ভারতীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটায়। অথচ অনেকেই ইউরো দেখে দেরিতে ঘুমিয়ে সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ উঠে চোখ কচলে দেখছেন, কোপা ফাইনাল তখনও প্রথমার্ধ চলছে! কারণ? খেলা শুরুর আগেই কার্যত রণক্ষেত্র স্টেডিয়াম, ধুন্ধুমার ঝামেলায় কিক-অফ পিছিয়ে গিয়েছে দেড় ঘন্টা!
খেলাধুলোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই অন্য ধারার। ক্রিকেট, ফুটবলের মত 'মেনস্ট্রিম' খেলার চাইতে বেসবল বা আমেরিকান ফুটবলের মত বিচিত্র খেলায় মার্কিনিদের আগ্রহ বেশি। ফুটবল তাও 'সকার'-টকার বলে খেলা হয়। ক্রিকেটের সঙ্গে আমেরিকানদের সম্পর্ক পর্বতারোহণের সঙ্গে রজার ফেডেরারের সম্পর্কের মতোই। তারপরেও প্রায় পিঠোপিঠি সময়ে আমেরিকায় পর পর দুটো বড়মাপের টুর্নামেন্ট আয়োজিত হল। বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে আইসিসি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পাশাপাশি টি-২০ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব দিল আমেরিকাকে। রাতারাতি নিউ ইয়র্কে বানানো হল অস্থায়ী স্টেডিয়াম। এদিকে ক্রিকেটের রেশ থাকতে থাকতেই আমেরিকা জুড়ে শুরু হল কোপা আমেরিকা। সব মিলিয়ে প্রায় জমজমাট অবস্থা!
অথচ দুই টুর্নামেন্টেই দেখা গেল, স্রেফ অব্যবস্থায়, জটিলতায় নাজেহাল হতে হল দর্শকদের।
ক্রিকেট নিয়ে শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিল একাধিক দেশ। নিউ ইয়র্কের অস্থায়ী স্টেডিয়ামে রাতারাতি বাইরে থেকে এনে ফেলা পিচ আদৌ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উপযুক্ত কিনা, প্রশ্ন তুলেছিলেন রোহিত শর্মারা। বিমান ও হোটেল বিভ্রাটে জেরবার হতে হয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানকে। তাও, খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়নি। এমনিতে, ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহ বেশিরভাগটাই আমেরিকায় প্রবাসী দক্ষিণ এশীয়দের। মুখ্যত ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের জনতাই ভিড় বাড়িয়েছেন। তার ওপর গ্রুপ পর্যায়ের পরে আর খেলা হয়নি আমেরিকায়। নকআউট চলেছে ক্যারিবিয়ান সাগরের বিভিন্ন দ্বীপে। ফলে অল্পের ওপর দিয়েই ফাঁড়া কেটে বেরিয়ে গিয়েছে আইসিসি।
কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল কনফেডারেশন কনমেবলের কার্যত নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছেন মার্কিন আয়োজকরা। শুধু তাই নয়। শিয়রে সংক্রান্তি ভেবে এবার চিন্তায় পড়েছে ফিফা।
মাত্র দু'বছর। ২০২৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপ হতে চলেছে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভৌগলিক এলাকা জুড়ে! বস্তুত, খেলাধুলোর ইতিহাসেও এত বড় এলাকা জুড়ে কোনও টুর্নামেন্ট আয়োজনের নজির নেই। আয়োজক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, কানাডা। ৩২-এর জায়গায় ৪৮ দল খেলবে। ষোলোটি শহর জুড়ে মোট ১০৮-টি ম্যাচ খেলা হবে। ২০২৬ সালের ১১ জুন, বৃহস্পতিবার মেক্সিকো সিটির বিশ্ববিখ্যাত আজতেক স্টেডিয়ামে শুরু হবে বিশ্বকাপ। ফাইনাল খেলা হবে নিউ ইয়র্কের মেটলাইফে। এরকম বিশাল, বিস্তৃত ভৌগলিক ব্যাপ্তি মানে সব মিলিয়েই ঘড়ির সঙ্গে তাল মেলানো একটা চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে ফুটবলারদের কাছে। দক্ষিণে মেক্সিকো সিটি যেখানে প্রায় কর্কটক্রান্তি রেখার কাছে, ক্রান্তীয় আবহাওয়া অঞ্চলে, উত্তরে টরন্টো সেখানে প্রায় মেরুবৃত্তরেখার কাছে।
এই অবস্থায় বিশ্বকাপের আগে পরিকাঠামো কেমন দেখার জন্য আদর্শ মঞ্চ হতে পারত কোপা আমেরিকা। কিন্তু সব দিক দিয়ে ডাহা ফেল করেছে আমেরিকা। প্রত্যেকটি ম্যাচ বিশ্বমানের বড় বড় শহরে হয়েছে। নিউ ইয়র্ক, আটলান্টা, হিউস্টন, মায়ামি, কানসাস সিটি, ওরল্যান্ডোর মত শহর ছিল আয়োজনের দায়িত্বে। দুয়েকটি মাঠ বাদে প্রায় সবক'টির গ্যালারিতেই ষাট হাজার দর্শকের ওপর বসার ব্যবস্থা আছে। নিয়মিত ন্যাশনাল ফুটবল লিগের ম্যাচ হয়। অথচ দেখা গেল, উদ্যোক্তাদের বিন্দুমাত্র সতর্কতা নেই। সাধারণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাতেই গড়বড় থেকে গিয়েছে। মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামের কথাই ধরা যাক। মাঠের চৌহদ্দির বাইরে যে সাধারণ নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকে, অভিযোগ, কোপা ফাইনালের দিন সেটাতেই গড়িমসি ছিল। ফলে বিনা টিকিটের দর্শকদের কার্যত আটকানোই যায়নি। স্টেডিয়ামের শাটার, সার্ভিস উইন্ডো বা অন্যান্য ফাঁকফোকর গলে কাতারে কাতারে লোক ঢুকে পড়েছে। অথচ বৈধ টিকিটধারীদের হয়রানি হতে হয়েছে প্রবেশদ্বারে।
কোথাও মাঠের বাইরে নিরাপত্তা নেই। কোথাও নিরাপত্তাবেষ্টনী ঢিলেঢালা। কোথাও সাধারণ গণপরিবহণ পাওয়া যায়নি। কোথাও পার্কিং পেতে সমস্যা হয়েছে। কোপা আমেরিকা জুড়ে এমন অভিযোগে জেরবার কনমেবল। কানসাস সিটিতে একটি ম্যাচে আবার তাপমাত্রা এমন বেড়ে গিয়েছিল, গরমে এক সহকারী রেফারি মাঠের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিকেল পাঁচটায় গনগনে রোদ। মাঠ প্রায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। অবস্থা দেখে মনে হবে, কলকাতা এর চেয়ে অনেক ভাল। ২০১৭ সালে অনুর্দ্ধ সতেরো বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল ভারত। ফাইনাল হয়েছিল কলকাতায়। পাশাপাশি, ফিফার বৈঠক চলেছিল। তাবড় ফিফা কর্তারা উড়ে এসেছিলেন কলকাতায়।
তখনও ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো উদ্বোধন হয়নি। তৈরি হয়ে যাওয়া স্টেশন কাঠামোটুকু ছিল। সেটিকেই সুচারুভাবে ব্যবহার করেছিল পুলিশ। ফাইনালের দিন যুবভারতীকে কার্যত নজিরবিহীন নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলেছিল কলকাতা ও বিধাননগর পুলিশ। কাদাপাড়া থেকে বেলেঘাটা অবধি বিস্তীর্ণ অংশে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে, মেট্রোর অসমাপ্ত স্টেশনের সিঁড়িকেই ওভারব্রিজ হিসেবে ব্যবহার করে দুর্দান্ত দক্ষতায় ম্যাচ উতরে দিয়েছিল পুলিশ। প্রশংসা করে গিয়েছিলেন ফিফা কর্তারা। মধ্যরাত অবধি রাজ্য সরকারের পরিবহণ দফতরের একের পর এক বাতানুকূল বাস শাটল সার্ভিস দিয়েছিল। নিজে তদারকি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
অথচ কলকাতা যা পারে, পৃথিবীর অন্যতম সেরা আন্তর্জাতিক শহর মায়ামি সেটা করে দেখাতে পারল না। ভক্তরা স্থানীয় প্রশাসনকেই দুষছেন এইজন্য। কিন্তু বৃহত্তর প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছে এবার। কোপাতেই এই বেহাল দশা হলে, বিশ্বকাপে কী হবে আমেরিকার?