ফাইনালের জন্য প্রস্তুত লামিন ইয়ামাল ও জুড বেলিংহ্যাম।
শেষ আপডেট: 14th July 2024 20:16
এরকম একটা রোববার পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা!
কাকে ছেড়ে কাকে দেখবেন? আপাতত এটার উত্তর দেওয়াই সবচেয়ে কঠিন কাজ। বিকেলে ভারত-জিম্বাবোয়ে। সিরিজ জিতে অবশ্য এটা নিয়মরক্ষার ম্যাচ হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যেয় উইম্বলডন পুরুষদের ফাইনাল। নোভাক জোকোভিচের মুখোমুখি কার্লোস আলকারাজ। রাতে উয়েফা ইউরোর ফাইনাল। ধুন্ধুমার যুদ্ধে স্পেনের সামনে ইংল্যান্ড! ওদিকে ভোরের আলো ফুটতেই কোপা আমেরিকা ফাইনাল। লিওনেল মেসির আর্জেন্তিনার মহড়া নেবে কলম্বিয়া।
রসিকজনেরা বলাবলি করছেন, এর সবকিছুর ওপরে আছে দুপুরের ভাতঘুম! আদতে রোববারের দুপুরে একটু গড়িয়ে নেওয়ার ওপরেই নাকি দাঁড়িয়ে আছে সবটা! সত্যিই তো, নইলে টানা যাবে?
কাকে দেখতে রাত জাগবেন আজ? লামিন ইয়ামাল? জুড বেলিংহ্যাম? বুকায়ো সাকা? নাকি ফাবিয়ান রুইজ-রদ্রি-দানি ওলমোদের মাঝমাঠের ধামাকা? বস্তুত, আজ দুই দল ছন্দে থাকলে লড়াইটা হতে পারে দুই ফুটবল দর্শনের। বা, হয়ত একটু কাঠখোট্টাভাবে বললে, স্পেনীয় দর্শন বনাম ব্রিটিশ বুদ্ধি। ইউরোর ফাইনাল যদি নয়াদিল্লি হয়, দুই দল হাওড়া থেকে দু'ভাবে পৌঁছেছে। স্পেন রাজধানী এক্সপ্রেসের ফার্স্ট ক্লাসে চেপে সরাসরি দিল্লি নেমেছে। গ্রুপ পর্যায়ে পাঁচ গোল, নকআউটে শেষ ষোলোয় চার গোল, কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে জোড়া গোল করে মোট ১৩ গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছে লুইস দে লা ফুয়েন্তের বাহিনী। ওদিকে ইংল্যান্ড প্রথমে ধানবাদ অবধি ব্ল্যাক ডায়মন্ডে, সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে মুঘলসরাই, তারপর স্লিপারে কানপুর হয়ে শুধু শেষ রাস্তাটা শতাব্দী ধরে দিল্লি পৌঁছেছে। গ্রুপ পর্যায়ে সব মিলিয়ে দুই গোল, তারপর নকআউটে সবসুদ্ধ পাঁচ গোল হয়েছে। মোট ৭ গোল। অন্তত সেমিফাইনালের আগে অবধি ইংল্যান্ডের খেলা থাকলে মাঠকর্মীদের বিয়ারের গ্লাস কুড়োতে বেশি পরিশ্রম করতে হত। সেমিফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে অবশ্য এখন গ্যারেথ সাউথগেট প্রায় জাতীয় ব্রিটিশ আইকনে পরিণত হয়েছেন। আশা করা যায়, ইউরো জিতলে নাইটহুড পেয়ে যেতে পারেন!
ঔপনিবেশিক আমলে স্পেন ও ব্রিটেন ছিল সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুই মহাশক্তি। কিন্তু তাও ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের যেমন খটাখটি লেগেই থাকত, ইংরেজ-স্পেনীয় দ্বন্দ্ব অতটা বাড়াবাড়ি জায়গায় যায়নি। ষোলো শতকে একবার দু'পক্ষ যুদ্ধ করবে বলে কোমর বেঁধেছিল। কিন্তু শেষ অবধি জাহাজ-টাহাজ নিয়ে বেরিয়েও অতলান্তিকে প্রবল ঝড়ের কবলে পড়ে আর জুত করে লড়াই করা হয়ে ওঠেনি। পরে অবশ্য দু'পক্ষের নজর যায় পৃথিবীর দুই গোলার্ধে। যার ফলে আর মাথায় মাথায় সংঘর্ষ হয়নি। আমেরিকা স্বাধীনতা ঘোষণা করতেই ইংরেজদের নজর ঘোরে এশিয়া ও আফ্রিকায়, বিশেষত ভারতবর্ষে। ওদিকে স্পেনীয় কনকিস্তাদোররা গোড়া থেকেই হামলা চালাতে থাকেন অতলান্তিকের ওপারে, দুই আমেরিকায়। আজও উত্তরে মেক্সিকো থেকে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণতম বিন্দু অবধি আজকের 'লাতিন আমেরিকা'-র আঠারোটি দেশের সরকারি ভাষা স্পেনীয়। ব্যতিক্রম একমাত্র ব্রাজিল, যারা পর্তুগিজ বলে। ওদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় পৃথিবীর সর্বাধিক জনবহুল দেশে আজও সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে ব্যবহার করা হয়।
ফুটবল দুনিয়াতে আবার সম্প্রতি একটা অন্যরকম প্রতিযোগিতা চলছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই ফুটবল লিগ চলে ইংল্যান্ড ও স্পেনে। কিন্তু আপাতত ইংরেজদের প্রিমিয়ার লিগে কার্যত রাজত্ব করছেন স্পেনীয় ম্যানেজাররা। বস্তুত, ১৯৯২ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রিমিয়ার লিগে ২০১৬-১৭ মরসুমের আগে একবারও কোনও স্পেনীয় ম্যানেজার সাফল্য পাননি। কিন্তু রাতারাতি ছবিটা বদলে দেন পেপ গুয়ার্দিওলা। প্রিমিয়ার লিগে তিনিই প্রথম স্পেনীয় ম্যানেজার। ২০১৬-১৭ মরসুম থেকে মোট ছয়বার ম্যাঞ্চেস্টার সিটিকে লিগ চ্যাম্পিয়ন করেছেন পেপ। এবারেও তিনিই শেষ হাসি হেসেছেন। ওদিকে বাইশ বছর আর্সেনালের দায়িত্বে থাকার পর ২০১৮ সালে আর্সেন ওয়েঙ্গারের জায়গায় ম্যানেজার হয়ে আসেন উনাই এমেরি। মাত্র এক মরসুম পরেই অবশ্য তাঁকে সরতে হয়। আপাতত তিনি অ্যাস্টন ভিলার দায়িত্বে। যারা এবারের লিগে চতুর্থ হয়েছে। এখন আর্সেনালের ম্যানেজার দলেরই প্রাক্তন অধিনায়ক, স্পেনীয় মিকেল আর্তেতা। অর্থাৎ, এবারের প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে ওপরে থাকা চার দলের তিনটিতেই দায়িত্বে আছেন স্পেনীয়রা।
তাহলে আরও একটু ভেতরে ঢোকা যাক? ফাইনালে দুই দলে থাকা খেলোয়াড়দের মধ্যে মোট ২৩ জন আছেন, যারা ক্লাবে স্পেনীয় কোচের অধীনে খেলছেন। এই বছরের মে মাসে বার্সেলোনায় নতুন কোচের দায়িত্বে এসেছেন হ্যান্সি ফ্লিক। তার আগে অবধি কোচের দায়িত্বে ছিলেন কিংবদন্তী জাভি। তাঁকে ধরলে সংখ্যাটা ২৭ হবে। অন্তত পাঁচজন আছেন, যারা ইংল্যান্ডের প্রথম এগারোয় আছেন। সাউথগেট নিজে বলেছেন, পেপ গুয়ার্দিওলা তাঁর 'আইকন'। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির অভাবনীয় সাফল্যের পর আপাতত ব্রিটিশ ফুটবলে পেপ-যুগ চলছে বলা যায়। শুধু কি ব্রিটেন? ইউরো চলছে জার্মানিতে। ২০২৪ মরসুমে প্রথমবার বুন্দেশলিগা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বেয়ার লেভারকুসেন। ম্যানেজার, জাবি আলোন্সো।
ইংরেজরা মানতে না চাইলেও, ফারাকটা শুরু থেকেই দুই দলের ফুটবলে স্পষ্ট। স্পেন একেবারে ধ্রুপদী স্পেনীয় ঘরানায় খেলছে। মাঝমাঠ অত্যন্ত পোক্ত, দুই প্রান্ত ধরে আচমকা গতি বাড়িয়ে তোলা, আঁটসাঁট রক্ষণ, সামনে ফর্মে থাকা নিকো উইলিয়ামস ও লামিন ইয়ামাল, সঙ্গে আলভারো মোরাতা। স্পেনের সবচেয়ে বড় শক্তি, প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা বুঝে ত্বরিতগতিতে নিজেদের ছক পাল্টে ফেলা। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ৯ মিনিটের মাথায় পিছিয়ে গিয়েও মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে জোড়া গোল দিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন লামিন ইয়ামাল ও দানি ওলমো। জার্মানির বিরুদ্ধে আট মিনিটের মাথায় পেদ্রি চোট পেয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও একটুও টাল খায়নি স্পেন। ফাবিয়ান রুইজ ও রদ্রির যুগলবন্দি দেখে অনেকেই জাভি-ইনিয়েস্তা জমানার কথা টানছেন। সাংবাদিক সম্মেলনেও ফুয়েন্তে বললেন, 'আমাদের রদ্রি আছে। ও দলের কম্পিউটারের মত।'