শেষ আপডেট: 26th March 2024 20:59
দ্য ওয়াল ব্যুরো: দূরত্ব ১৩১০ কিলোমিটার। ওই ধরে নিন, হাওড়া থেকে দিল্লি বা তার একটু আগে। যেতে লাগবে প্রায় তিরিশ ঘন্টা মত! শুনলেই ভুরু কোঁচকাবেন? এইটুকু দূরত্ব তো রাজধানী বা দুরন্ত এক্সপ্রেসে তো সতেরো ঘন্টাতেই চলে যাওয়া যায়! তার চেয়ে বেশি পূর্বাও ওই মেরেকেটে একুশ ঘন্টা লাগায়। কিন্তু এই বিখ্যাত ট্রেনে উঠলে ওই অতিরিক্ত সময়টুকু গায়েই লাগবে না! গোটা রেললাইনটাই যেন প্রকৃতির একেবারে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে পাতা!
আমাদের ভারতের নয়, এই ট্রেনে চড়তে গেলে আপনাকে যেতে হবে তুরস্কে, একেবারে খাস অটোমান সুলতানদের দেশে। ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগে অবস্থিত তুরস্কের উপকূল জুড়ে রয়েছে ভূমধ্যসাগর-কৃষ্ণ সাগরের মোলায়েম পরশ। বসফোরাস প্রণালীর দু'পাশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সে'দেশের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তানবুল, এককালের বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল। পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক শহর, তুরস্কের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। অথচ যত দেশটার ভেতরে যাওয়া যায়, আবহাওয়া যেন ততই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে। আনাতোলিয়ার শীতে কাঁপ ধরিয়ে দেওয়া শুকনো পাথুরে মালভূমিতে রয়েছে দেশের রাজধানী আঙ্কারা, তুরস্কের রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র। আশপাশ খুঁজলে এখনও পাওয়া যাবে প্রাচীন অ্যাসিরিয়া, ব্যাবিলন, মেসোপটামিয়া, আক্কাদের বিক্ষিপ্ত প্রত্নক্ষেত্র।
এই আঙ্কারা থেকেই ছাড়ে দোগু এক্সপ্রেস। তুর্কি ভাষায় যার অর্থ, পূর্বাঞ্চলীয় এক্সপ্রেস।
শুরুতে এই ট্রেন ছিল আর পাঁচটা যাত্রীবাহী ট্রেনের মতই। কিন্তু কিছু যাত্রীর... বিশেষ করে বিভিন্ন দেশ থেকে বেড়াতে আসা কিছু পর্যটকের তোলা ছবির দৌলতে হঠাৎ-ই এই ট্রেনের কপাল খুলে গিয়েছে। ছবিতে দেখা গিয়েছে, যাত্রাপথের দু'ধারে অসামান্য প্রাকৃতিক শোভা। ফলে হু হু করে দোগু এক্সপ্রেসের চাহিদা বেড়ে গিয়েছে। অবস্থা এখন এমনই যে, এক মাস আগে মধ্যরাতে টিকিট কাটার ওয়েবসাইট চালু হলেই মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা ট্রেনের সব টিকিট বিকিয়ে যায়। অবস্থা এমনই যে, সামাল দিতে রীতিমত দোগু এক্সপ্রেসের সমান্তরালে আরও একটি 'ট্যুরিস্ট দোগু এক্সপ্রেস' চালু করেছে তুরস্কের রেল দফতর।
দোগু এক্সপ্রেস আঙ্কারা ছেড়ে রওনা হয় পুবদিকে, একেবারে আর্মেনিয়া সীমান্তে অবস্থিত ছোট্ট শহর কারস-এর দিকে। সন্ধ্যের একটু আগে ট্রেন ছাড়ে। কিছুক্ষণ আঙ্কারা শহরের নিশীথ দৃশ্য উপভোগ করবেন আপনি। তারপর শোবার তোড়জোড় শুরু করতে হবে। ভারতীয় রেলের মতই, সিট ছড়িয়ে বাঙ্ক করে নেওয়ার নিদান রয়েছে। আরামে ঘুমোবেন। পরদিন সকাল থেকে শুরু হবে আসল গল্প। ট্রেন এসে পৌঁছবে ইলিচ স্টেশনে। ছোট্ট গ্রামগঞ্জের মত এই স্টেশনের কাছেই রয়েছে এক বিখ্যাত গিরিখাত, যার নাম কারানলিক বা 'ডার্ক ক্যানিয়ন'। ট্রেন এগিয়ে যায় আরও পুবে, একেবারে আনাতোলিয়া মালভূমির শুকনো প্রান্তরে। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা, বছরের বেশিরভাগ সময়ে ঢেকে থাকে সাদা বরফের চাদরে। এক অসীম, জনবিরল শূন্যতার রাজ্যে কেবলই রাজ করে প্রকৃতি। তুরস্কের স্থানীয়রাও এই ট্রেনে চড়ে চমৎকৃত হ'ন। আনাতোলিয়ার প্রান্তরের এই এই অনন্ত, অব্যক্ত রিক্ততা ঠিক কতটা, তাঁদের অনেকেই এই ট্রেনে চড়ে বুঝতে পারেন।
সারাদিন এই সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে গিয়ে রাত নামার আগে ট্রেন আসে এরজুরুমে। তুর্কির রসনার জন্য বিখ্যাত এই এরজুরুম। এক জাতের ভেড়ার মাংসের কাবাব যার অন্যতম। রাতে বারো ঘন্টা ধরে ম্যারিনেশনের পর ঢিমে আঁচে পুরো কাবাব তন্দুর করার পদ্ধতি চলে, পরে নরম রুটি দিয়ে খাওয়া হয়। এরজুরুমের পর আর কয়েক ঘন্টা, ট্রেন এসে পড়ে কার্স স্টেশনে। শেষ হয় প্রায় মহাকাব্যিক এক ট্রেন যাত্রা।