মৃত্যুর পর মাইকেলের দেহ পরীক্ষা করার পর, লস অ্যাঞ্জেলস কাউন্টির শবপরীক্ষক মৃত্যুর কারণ হিসাবে লিখেছিলেন'হোমিসাইড'। অর্থাৎ খুন করা হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী মাইকেল জ্যাকসনকে। প্রপোফল ও বেনজোডায়াজিপাইন নামক দুটি ড্রাগের তীব্র বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে মাইকেলের। সন্দেহের তির ঘুরে গিয়েছিল মাইকেলের চিকিৎসক ডঃ কনরাড মুরের দিকে। বিচারের সময় কোর্ট বলেছিল involuntary manslaughter, খুন তবে অনিচ্ছাকৃত।
[caption id="attachment_2437641" align="aligncenter" width="460"]
গ্রেফতার হয়েছিলেন মাইকেল জ্যাকসনের চিকিৎসক কনরাড মুরে[/caption]
যখন ইউরোপ জুড়ে জ্যাকসনের সিরিজ নিয়ে চলছিল তুমুল উন্মাদনা, ঠিক তখনই ঘরের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন আতঙ্কিত মাইকেল। তিন ছেলে মেয়ে ও নিজস্ব চিকিৎসক ডঃ মুরে ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিতেন না নিজের শয়নকক্ষে। ঢুকতে দিতেন না সাফাইকর্মী ও পরিচারকদেরও।
আরও পড়ুন: আত্মহত্যা নয়! খুন হয়েছিলেন হলিউডের গ্ল্যামারাস নায়িকা মেরিলিন মনরো!
এই বিছানাতেই অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল জ্যাকসনকে[/caption]
এগারো মিনিট পাম্প করার পরও সাড়া মেলেনি মাইকেলের। পরে জানা গিয়েছিল কার্ডিওলজিস্ট ডঃ মুরে হার্ট পাম্পের সঠিক নিয়মই নাকি জানতেন না। জ্যাকসনের পিঠের তলায় একহাত ও বুকে একহাত রেখে পাম্প করেছিলেন। পুলিশকে ডঃ মুরে জানিয়েছিলেন, ঘরে ল্যান্ডলাইন না থাকায় তিনি আপৎকালীন নাম্বার '৯১১' তে ফোন করতে পারেননি। ফোন করেও পাননি জ্যাকসনের দেহরক্ষীদের। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখা হয়েছিল জ্যাকসনের রাঁধুনির সঙ্গে। সেই রাঁধুনিই ডেকে দিয়েছিলেন জ্যাকসনের দেহরক্ষীদের।
দেহরক্ষীরা ৯১১ নাম্বারে ফোন করে ডেকে এনেছিল প্যারামেডিকদের। তাঁরা এসে জ্যাকসনের জ্ঞান ফেরানোর প্রাথমিক চেষ্টা করেও অসফল হয়েছিলেন। এরপর গ্রিন করিডর দিয়ে নিথর জ্যাকসনকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটেছিল রোনাল্ড রেগন মেডিক্যাল সেন্টারে। কিন্তু তার আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল অমূল্য তিরিশটি মিনিট। ২০০৯ সালের ২৫ জুন, দুপুর ২.২৬ মিনিটে বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল এক নিদারুণ দুঃসংবাদের অভিঘাতে।
মৃত্যুর পর মাইকেল জ্যাকসনের শয়নকক্ষে ঢুকে হতবাক হয়েছিল লস অ্যাঞ্জেলসের পুলিশ! কে বলবে এটা ছিল কিংবদন্তি পপ সম্রাট ও শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ পারফর্মার মাইকেল জ্যাকসনের শয়নকক্ষ। এ যেন এক ছন্নছাড়া মাদকাসক্তের ঘর। এলোমেলো বিছানা। সারা ঘরে দুর্গন্ধ। বিছানার পাশের তাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চেতনানাশক ওষুধের ভায়াল ও সিরিঞ্জ। হাত বাঁধার রাবারের কর্ড। বিছানার পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার। হ্যাঙারে ঝুলছে রক্তমাখা সাদা জামা। চমকে গিয়েছিলেন ঘরে উপস্থিত সংবাদমাধ্যমের লোকেরাও।
[caption id="attachment_2437645" align="aligncenter" width="458"]
হ্যাঙারে ঝুলছে মাইকেল জ্যাকসনের রক্তমাখা সাদা জামা[/caption]
ডঃ মুরে কোর্টে বলেছিলেন, মাইকেল জ্যাকসনের পুরুষাঙ্গে রোজ রাতে তিনি হাত দিতেন। ক্যাথিটার পরানোর জন্য। কারণ দুশ্চিন্তায় বিছানা ভিজিয়ে ফেলতেন মাইকেল। পপ-সম্রাটের এতটাই ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন ডঃ মুরে। কিন্তু চিকিৎসক যখন রোগীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন, তখন বিস্মৃত হন তাঁর পেশার গুরুত্বের কথা। আর রোগী যদি মাদকাসক্ত হন এবং রোগীর নাম যদি হয় মাইকেল জ্যাকসন, তাহলে তো কথাই নেই!
[caption id="attachment_2437650" align="aligncenter" width="600"]
এই সেই ড্রাগ যা টানা ষাট দিন দেওয়া হয়েছিল মাইকেল জ্যাকসনকে[/caption]
প্রত্যেকদিন তীব্র চেতনানাশক ওষুধের ককটেল নিতেন চরম অনিদ্রার রুগী মাইকেল জ্যাকসন। নিজের হাতে ড্রাগের সেই ককটেল বানিয়ে দিতেন ডঃ মুরে। প্রথম দিকে ডঃ মুরে ককটেল ইনজেকশন দিলেও, শেষের দিকে নিজেই ড্রাগের ককটেল বানিয়ে নিজের শরীরে প্রবেশ করাতেন মাইকেল জ্যাকসন। এবং এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারটি জেনে বুঝে দিনের পর দিন হতে দিয়েছিলেন, রোগীর প্রাণ বাঁচানোর শপথ নেওয়া ডঃ মুরে।
পুলিশের কাছে ডঃ মুরে স্বীকার করেছিলেন, মাইকেল জ্যাকসনকে ঘুম পাড়াবার জন্য তিনি টানা ষাট দিন তীব্র নার্ভ এজেন্ট 'প্রপোফল' ইনজেকশন দিয়েছিলেন। যে ড্রাগটি অপারেশনের আগে রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহার করা হয়। অবশ্য ডঃ মুরে কোর্টে বারবার বলেছিলেন, জ্যাকসন নিজেই নিজেকে খুন করেছেন। কিন্তু কোর্ট বলেছিল জেনেশুনে রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন ডঃ মুরে। তাই ইনভলান্টারি ম্যানস্লটার-এর অপরাধে, দু’বছরের জেল হয়েছিল ডঃ মুরের।
ভাবতেই অবাক লাগে। যিনি ‘ইউ আর নট অ্যালোন’ গানটি গেয়ে, সারা বিশ্বের কোটি কোটি হতাশ মানুষকে ফিরিয়ে এনেছিলেন জীবনে। তিনিই যে সবার অলক্ষ্যে জীবন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন, সেটা টের পাননি কেউই। তবে একজন ছাড়া। তিনি ডঃ কনরাড মুরে। মাইকেল জ্যাকসনের নির্মম মৃত্যু আসন্ন, সেটা জানতেন মাসে দেড় লক্ষ ডলারের নেশায় বুঁদ থাকা ডঃ মুরে। যিনি জীবন দিতে এসে জীবন নিয়ে নিয়েছিলেন, ইতিহাসের সর্বকালের সর্বসেরা পারফর্মার মাইকেল জ্যাকসনের।

জীবনের শেষ দিনগুলি কেটেছিল অস্থিরতায়
ধীরে ধীরে মাইকেলকে গ্রাস করছিলো তীব্র অর্থাভাব। অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করেছিলেন মাইকেল। নতুনভাবে ফিরে আসতে চাইছিলেন কামব্যাক-শো করে। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত,লন্ডনে হওয়ার কথা ছিলো তাঁর কামব্যাক সিরিজ। এক কোটির মতো দর্শক আশা করছিলেন সিরিজের প্রোমোটাররা। দু'মাস ধরে দিনরাত এক করে রিহার্সাল দিয়ে যাচ্ছিলেন জ্যাকসন। সিরিজের নাম দিয়েছিলেন, 'ফাইনাল কার্টন কল'। কিন্তু কেন! মাইকেল কি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর জীবনের যবনিকা পতন আসন্ন!
অভিশপ্ত ২৫ জুন
আগের দিন স্টেপল সেন্টারে রিহার্সাল করেছিলেন জ্যাকসন। শো-এর প্রোমোটারদের সঙ্গে মিটিং সেরে ফিরেছিলেন লস অ্যাঞ্জেলসের প্রাসাদোপম বাড়িতে। পরের দিন, ২০০৯ সালের ২৫ জুন, দুপুর বারোটা নাগাদ জ্যাকসনকে অচৈতন্য অবস্থায় শয়নকক্ষে আবিষ্কার করেছিলেন ডঃ মুরে। তখনও জ্যাকসনের শরীর গরম ছিল, নাড়ির গতি ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। দেরি না করে মাইকেলের হার্ট পাম্প করতে শুরু করেছিলেন ডঃ মুরে। [caption id="attachment_2437644" align="aligncenter" width="395"]
“জ্যাকো ইজ ডেড”


ডঃ মুরে বিচারককে বলেছিলেন শিউরে ওঠার মতো কিছু কথা
মাইকেল জ্যাকসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডঃ মুরে কোর্টকে জানিয়ে ছিলেন, জীবনের শেষদিনগুলিতে ভীষণ সন্দেহবাতিক হয়ে গিয়েছিলেন জ্যাকসন। তাঁর ধারণা হয়েছিল, পরিচারকরা ঘর পরিষ্কার করতে এসে তাঁর অন্তর্বাস চুরি করে নিলামে বেচে দিতে পারে। তাই তিনি তাঁর অন্তর্বাস কাউকে কাচতে দিতেন না। বিচারকের কাছে দেওয়া ডঃ মুরের হলফনামা বলছে, জীবনের শেষ কয়েক বছর সম্পূর্ণভাবে মাদকাসক্ত হয়ে গিয়েছিলেন মাইকেল। এবং সেই জন্যই তাঁর দরকার ছিল একজন বিশ্বস্ত ডাক্তারের। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ডঃ মুরেকে। মাসে দেড় লক্ষ ডলার মাইনের লোভ সামলাতে পারেননি ডঃ মুরে। মাইকেলের ব্যক্তিগত চিকিৎসকের চাকরি করতে এসে, হয়ে উঠেছিলেন জ্যাকসনের থেকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর এটিই ছিল মাইকেল জ্যাকসনের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। সেই দিন থেকেই মাইকেল জ্যাকসন এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যুর দিকে।

