শেষ আপডেট: 5th August 2024 20:59
দ্য ওয়াল ব্যুরো: কলকাতা ও কেমব্রিজের সেতুবন্ধন, তাও আবার চিকিৎসা ক্ষেত্রে! কলকাতার বাঙালি চিকিৎসক, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অরুণাভ ধর তেমন কাণ্ডই ঘটিয়েছেন। কেমব্রিজের অ্যাডেনব্রুক হাসপাতালের সঙ্গে মিলিয়েছেন কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজকে। সৌজন্যে, তাঁর আবিষ্কার করা 'ওয়াও'। এই কাজ ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে ইংল্যান্ডে। এবার পালা এদেশেও একে প্রতিষ্ঠিত করার।
ডক্টর অরুণাভ ধর নবজাতক স্পেশ্যালিস্ট বা নিয়োন্যাটোলজিস্ট। যেখানে শিশুকে বড় হাসপাতালে পৌঁছনো সম্ভব নয়, সেখানে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। বস্তুত, রাতবিরেতে বা গ্রামেগঞ্জে হঠাৎ করে ছোট্ট শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে, হাসপাতাল অবধি পৌঁছতেই অনেকটা সময় লেগে যেতে পারে। ফোনে বা ভিডিও কলে সমস্যা শুনে চিকিৎসা বড়দের ক্ষেত্রে খানিকটা সম্ভব হলেও, বাচ্চার পক্ষে তা সম্ভব নয়। কারণ শিশুকে সামনে থেকে, স্পর্শ করে দেখা জরুরি। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই ডক্টর অরুণাভ এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যাতে দেশের ছোট-বড় সব হাসপাতালকে এক ছাতার তলায় আনা যাবে। আর এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসেই চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যাবে। এই ব্যবস্থার নাম ‘ওয়ার্কস্টেশন অন হুইল’ বা সংক্ষেপে ‘ওয়াও’।
‘রিয়্যাল টাইম রিসোর্স লোকেটর ফর অ্যাকিউট নিয়োনেটাল ট্রান্সফার সার্ভিস’ বা সংক্ষেপে ‘লোকঅ্যান্টস’-- এই পদ্ধতি কাজ করে ওয়াও পরিষেবা। কীরকম? ডাক্তারবাবু জানালেন, এই ‘ওয়াও’ আসলে কিছুই নয়, চাকা লাগানো একটি ট্রলি বা ঠেলাগাড়ি। সেই গাড়ির উপরে বসানো থাকে হাই-ডেফিনেশন ক্যামেরা-যুক্ত একটি মনিটর। তার সঙ্গে থাকে একটি স্পিকার এবং দু’টি সাউন্ড বক্স। অসুস্থ শিশুদের কাছে যদি এই ওয়াও বসানো থাকে, তাহলে অনেক দূরের বড় হাসপাতাল থেকে রোগীকে সহজেই দেখা যায়। তার শব্দ শোনা যায়। আশপাশে কী ঘটছে তা-ও চিকিৎসকদের নজরে পড়ে।
আবার এই ওয়াও-এর পরিপূরক হিসেবে এই ব্যবস্থার দ্বিতীয় সফ্টঅয়্যার ভাগটি থাকে বড় হাসপাতালে। সেখানেও থাকে বিশাল একটি মনিটর। সেটির মাধ্যমে শিশুর শারীরিক পরিস্থিতি সরাসরি দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি অন্যত্র রোগীর কাছে বসানো ওয়াও ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণও থাকে বড় হাসপাতালের চিকিৎসকদের হাতে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, ভিডিও কলের সঙ্গে এই ব্যবস্থার ফারাক কী?
ডাক্তারবাবু জানাচ্ছেন, শিশুকে কেবল স্ক্রিনে দেখা যায় ভিডিও কলে। কিন্তু এই ওয়াও মনিটর 'চিকিৎসকদের চোখ' হিসেবে দেখায় শিশুদের। যার মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে বসে ‘ভার্চুয়ালি’ সদ্যোজাতের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। পরিবারের পাশে থাকা থেকে শুরু করে অসুস্থ শিশুর অভিভাবক বা নার্সদের সঙ্গে কথা বলা এবং যতটা সম্ভব নির্ভুল চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়াই এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য। অরুণাভর কথায়, 'ক্যামেরা জুম করে শিশুটিকে একেবারে কাছ থেকে দেখতে পারছি। বাচ্চার মা-বাবা কিংবা সেখানে উপস্থিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলছি। রোগীর পরিস্থিতি বুঝে চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটাই সাহায্য করছে এই ব্যবস্থা।'
বেলঘরিয়া হাই স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে আরজি কর হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাশ করেন অরুণাভ। তার পরে বিধানচন্দ্র রায় মেমোরিয়াল হাসপাতাল এবং বিধানচন্দ্র রায় পোলিও ক্লিনিক হাসপাতালে কাজ করার পরে ২০১০ সালে তিনি পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে, যোগ দেন কেমব্রিজের অ্যাডেনব্রুক হাসপাতালে। সেখানেই নিয়োনেটোলজি নিয়ে হাতে-কলমে কাজ শুরু করেন।
তবে ওয়াও আবিষ্কারের পিছনে বিশেষ একটা ঘটনা রয়েছে অরুণাভর জীবনে। ২০১৮ সালের এক কনকনে শীতের রাতে হঠাৎ ডাক পড়ে অরুণাভর। পূর্ব ব্রিটেনের ‘অ্যাকিউট নিয়োন্যাটাল ট্রান্সপোর্ট’ চিকিৎসক ছিলেন তিনি। সেখান থেকে ১০০ মাইল দূরত্বের একটি ছোট হাসপাতাল থেকে ফোন পান অরুণাভ। কারণ সেখানেই ছুটি কাটাতে এসে সময়ের আগে এক শিশুর জন্ম দেন এক তরুণী। শিশুটি প্রিম্যাচিওর্ড ছিল বলে তার নানা সমস্যা দেখা দেয়, যার চিকিৎসা করার মতো পরিষেবা ওই ছোট হাসপাতালে ছিল না। এদিকে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরেই তরুণী মায়েরও শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর স্বামী অর্থাৎ সদ্যোজাতটির বাবাকে থাকতে হয়, তাঁদের ৭ বছরের মেয়ের কাছে।
এই অবস্থায় সদ্যোজাত শিশুকে ১০০ মাইল দূরের বড় হাসপাতালে সরানো প্রায় অসম্ভব ছিল। সেই সময়েই অরুণাভর ভাবনায় আসে, কীভাবে বাঁচানো যায় বাচ্চাটিকে। কারণ তিনি বর্ণনা শুনেই বুঝেছেন, চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করলে বেঁচে যেতেও পারে সে। ওই হাসপাতালে আছেন চিকিৎসকও। প্রয়োজন শুধু সঠিক ভাবে সঠিক জায়গায় চিকিৎসাটি পৌঁছে দেওয়ার। তার জন্য চাই উন্নত প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির ভাবনা থেকেই জন্ম 'ওয়াও'-এর।
অরুণাভর এই কাজে তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর বন্ধু, পেশায় প্রযুক্তিবিদ রণদীপ চট্টোপাধ্যায়। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের চিকিৎসক সুজ়েন ব্রস্টারও ছিলেন সেই টিমে। তাঁরা ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি জটিল ক্ষেত্রে শিশুদের চিকিৎসায় অরুণাভর তৈরি ব্যবস্থার সাহায্য নিয়েছেন। সে দেশের চারটি হাসপাতালে এই নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে পরীক্ষামূলক ভাবে।