দক্ষিণ ভারতে ঝড় তুলে দিল ইন্ডিয়া, একমাত্র অন্ধ্রে এনডিএ শরিক টিডিপি সরকার গড়ার পথে।
শেষ আপডেট: 4th June 2024 22:03
দ্য ওয়াল ব্যুরো: প্রাচীন ও মধ্যকালীন ভারতের ইতিহাসের নানা পর্যায়ে দিল্লি-আগ্রার সাম্রাজ্যের সামনে বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল দক্ষিণ ভারত জেতা। স্বয়ং 'ভারতের নেপোলিয়ন' সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্য অভিযান করলেও শেষ অবধি বার্ষিক কর আদায়ের নীতি মেনে তাঁদের স্বশাসন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সভাকবি হরিষেণ এলাহাবাদ প্রশস্তিতে এটাকে 'গ্রহণ পরিমোক্ষ' নীতি বলে মেনেছিলেন। বলা হয়, সেটা ছিল সমুদ্রগুপ্তের তুখোড় কূটনৈতিক বুদ্ধির প্রমাণ। পরে মুঘল আমলেও দাক্ষিণাত্যকে পুরোপুরি বাগে আনা যায়নি। কখনও দুর্ধর্ষ পল্লব, চোল, চালুক্যরা, কখনও বিজয়নগর, কখনও বিজাপুর-গোলকোণ্ডার সুলতানরা স্বাধীনভাবে নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশদের সামনেও সমানে সমানে লড়াই করেছিলেন মহীশূরের হায়দর আলি।
ইতিহাস কি বর্তমানকে প্রতিফলিত করতে পারে?
সবসময় হয়ত করে না। কিন্তু ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলকে যদি একনজরে দেখা যায়, তাহলে এবারেও প্রায় একই ধারা অব্যাহত রইল। 'অব কি বার/চারশো পার' দূরে থাক, গোদাবরীর ওপারে বিজেপিকে একমাত্র আশা দেখাল অন্ধ্রপ্রদেশ। বাকি চার রাজ্যের মধ্যে তেলঙ্গানায় আসন বাড়িয়েছে বিজেপি, কিন্তু আসন কমেছে কর্ণাটকে। কেরল ও তামিলনাড়ুতে দাগই কাটতে পারেনি নরেন্দ্র মোদীর দল।
যেমন ধরা যাক, তামিলনাড়ু। প্রচারে কোনও কমতি রাখেননি নরেন্দ্র মোদী। লাগাতার দিল্লি থেকে এসে প্রচার করেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা। বুথ-ফেরত সমীক্ষাতেও ইঙ্গিত মিলেছিল, বিজেপি অন্তত চারটি আসন পেতে পারে। কিন্তু আসল খেলা শুরু হতেই বোঝা গেল, ছবিটা সম্পূর্ণ আলাদা। মোট ৩৯ আসনের সবক'টিতেই একেবারে চরম দাপট রেখে জিতল 'ইন্ডিয়া' জোট। নেতৃত্বে অবশ্যই দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম বা ডিএমকে। মোট ২২ আসনে তুমুল দাপট রেখে জিতেছে তারা। জোটসঙ্গী কংগ্রেস জিতেছে ৯ আসনে। ডিণ্ডিগুল আসনে সাড়ে ৪ লক্ষ ৪৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন সিপিএমের আর সচ্চিদানন্দম। তিরুপুর ও নাগাপট্টিনমে জিতেছে সিপিআই। কংগ্রেসের নামী প্রার্থীদের মধ্যে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদম্বরমের পুত্র কার্তি চিদম্বরম শিবগঙ্গা আসনে ২ লক্ষ ভোটে এগিয়ে থেকেছেন। চেন্নাই সেন্ট্রাল আসনে ২ লক্ষ ৪৪ হাজার ভোটে জিতেছেন ডিএমকের দয়ানিধি মারান। বিজেপি একটিতেও জিততে পারেনি। জেতেনি এআইএডিএমকেও।
এবারে তামিলনাড়ু জুড়ে বিজেপির হয়ে জোরালো হাওয়া তুলেছিলেন রাজ্যের বিজেপির প্রধান, ২০১১ ব্যাচের আইপিএস অফিসার আন্নামালাই। ২০১৯ সালে চাকরি ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। এবারে কোয়ম্বতুরে প্রার্থী হয়েছিলেন আন্নামালাই। জোর জল্পনা ছিল, জিততে পারেন তিনি। ১ লক্ষ ১৬ হাজার ভোটে ডিএমকের গণপতি রাজকুমারের কাছে পরাজিত হয়েছেন তিনি।
কেরলে অবশ্য বিজেপির জন্য খানিক ভাল খবর রয়েছে। ত্রিশূর আসনে ৭৪ হাজার ৬৮৬ ভোটে জিতেছেন বিজেপি প্রার্থী সুরেশ গোপী। আলাথুর আসনে মাত্র ২০ হাজার ভোটে জিতেছেন সিপিএম প্রার্থী কে রাধাকৃষ্ণণ। পোন্নানি ও মলপ্পুরম পেয়েছেন ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ প্রার্থীরা। বাকি সব আসনেই একচেটিয়া জিতেছেন কংগ্রেস। সব মিলিয়ে কেরলে চালকের আসনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ জোট। কিন্তু এই একটা আসন পাওয়াই বিজেপির জন্য বড় খবর। কারণ স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে আগে কখনও বিজেপি সাংসদ পায়নি কেরল। এই প্রথম পদ্মফুল ফুটল কেরলে।
বিজেপির পক্ষে কর্ণাটকের ফলাফলও বড়সড় ধাক্কা। ২০১৯ লোকসভায় কর্ণাটকের ২৮ আসনের মধ্যে ২৫ আসনেই জিতেছিল বিজেপি। কংগ্রেস একমাত্র জিতেছিল বেঙ্গালুরু গ্রামীন আসনে। সেখানে এইবার ২৮ আসনের মধ্যে ১৭ আসনে জিতেছে বিজেপি। কংগ্রেস জিতেছে ৯ আসনে, জেডিএস ২ আসনে। মাণ্ড্য আসনে বড় ব্যবধানে জিতেছেন এইচডি কুমারস্বামী।
তবে বিজেপি তথা এনডিএর জন্য বড়সড় জয়ের খবর শোনাল অন্ধ্রপ্রদেশ। জোটসঙ্গী চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলুগু দেশম পার্টি মোট ২৫ আসনের ১৬-টিতেই জিতে গিয়েছে। বিজেপি পেয়েছে তিনটি আসন। পাশাপাশি, অন্ধ্রপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনও চলছে। সেখানেও তেলুগু দেশম এগিয়ে রয়েছে দেড়শোর কাছাকাছি আসনে। এতদিন চন্দ্রবাবু নাইডুকে নানা ভাবে দূর্নীতির অভিযোগে হয়রান করেছে জগন রেড্ডির সরকার। গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু এখন যা অবস্থা, তাতে মুখ্যমন্ত্রী পদে চন্দ্রবাবুর বসা প্রায় সময়ের অপেক্ষা। তার ওপর বিজেপি যেভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, তাতে জাতীয় রাজনীতিতেও চন্দ্রবাবু বড় ভূমিকা নিতে চলেছেন।
তবে দক্ষিণ ভারতে সবচেয়ে নজিরবিহীন বিপদের মুখে পড়লেন সম্ভবত তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বা অধুনা 'ভারত রাষ্ট্র-সমিতি'-র কে চন্দ্রশেখর রাও। ২০১৯ নির্বাচনে মোট ১৭ আসনের ৯ আসনই পেয়েছিল বিআরএস। বিজেপি পেয়েছিল তিনটি, কংগ্রেস পেয়েছিল চারটি আসন। হায়দরাবাদে যথারীতি আসন ধরে রেখেছিলেন আসাদুদ্দিন ওয়েইসির এআইএমআইএম। কিন্তু এবারে কার্যত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে বিআরএস। বিজেপি এবং কংগ্রেস, দুই দল জিতেছে ৮ আসনে। কেবলমাত্র হায়দরাবাদেই একইভাবে ক্ষমতা ধরে রাখলেন এআইএমআইএমের আসাদুদ্দিন ওয়েইসি। মাধবীলতাকে নিয়ে বিজেপি বিস্তর হাওয়া গরম করার চেষ্টা করলেও শেষ অবধি ৩ লক্ষ ৩৮ হাজার ভোটে জয় পেলেন ওয়েইসি।